সোনালী দিনের আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ/ফাইল ছবি

এল ক্ল্যাসিকো। দ্য ক্ল্যাসিক। ফুটবলের সবচেয়ে ধ্রুপদী লড়াই। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের লড়াই। লিওনেল মেসি আর সার্জিও রামোসদের লড়াই। গোটা বিশ্ব যে লড়াই দেখতে মুখিয়ে থাকে, যে ক্ল্যাসিকোর দিনে দুনিয়া থমকে যায়। বাংলায়ও সে ঝাঁজটা দেখা যায়, অনুভব করা যায়!

আপনি ভেবে বসতে পারেন ডিশ নেটওয়ার্ক আর আন্তর্জালের অবাধ প্রসারেই ছেলেপুলেদের মাথা খেয়ে বসেছে এই ফুটবল। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা মোটেও তেমন কিছু নয়। আকাশ সংস্কৃতির প্রসারের আগেও এমন দৃশ্যের দেখা মিলতো হরহামেশাই। দুই-তিন প্রজন্ম আগের মানুষেরাও মজেছেন ফুটবল রোমাঞ্চে। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগেও ফুটবল নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলতো ঢাকার রাস্তা থেকে মফস্বলের চায়ের দোকান, বুদ্ধিজীবির কলাম থেকে নির্বোধের গালমন্দ পর্যন্ত। সে দৃশ্যের মধ্যমণি থাকতো আবাহনী-মোহামেডানের লড়াই, বাংলার ‘এল ক্ল্যাসিকো’।

শুধু যে নামেই, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। খেলার ধরণ, ক্লাবের দর্শনেও ছিল স্প্যানিশ ফুটবলের কুলীন দুই দলের ছাপ। তবে ব্যাপারটা সহজাতভাবেই এসেছে। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগ থেকেই মোহামেডান ছিল ঐতিহ্যবাহী দল। তখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা হতো ভিক্টোরিয়া-ওয়ান্ডারার্সের।

আর যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ছিল গণমানুষের দল। পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক অনাচারের শিকারও হয়েছে দলটি, ঠিক যেমন স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী যুগে যার মুখে পড়েছিল বার্সেলোনা।

খেলার ধরণেও স্বর্ণযুগের বার্সেলোনার ছাপ ছিল আবাহনীর ফুটবলে। ইয়োহান ক্রুইফ-যুগের পর থেকে বার্সেলোনা যেমন ছোট ছোট পাসে আক্রমণে ওঠার কৌশলে খেলেছে, আইরিশ কোচ উইলিয়াম বিল হার্টের আবাহনী সে কৌশলে খেলেছে তারও অনেক আগে। 

আবাহনীর তৎকালীন উইঙ্গার আশরাফউদ্দীন চুন্নু সে স্মৃতি রোমন্থনে বললেন, ‘আমরা তখন খুবই সুন্দর ফুটবল খেলতাম। ছোট ছোট পাসে আক্রমণে উঠতাম, অফ দ্য বলেও বেশ পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলতাম।’ এমন কিছু বাংলাদেশের দর্শক দেখেনি কখনো, তাই দলের ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হতেও সময় নেয়নি মোটেও।

ফলে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের প্রধান প্রতিপক্ষ বনে যায় আবাহনী, ঢাকার ফুটবল পায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতার স্বাদ। সে সময়ে দুই দলের সূচিও ফেলা হতো লিগের একেবারে শেষ দিনে। খেলায় থাকতো অঘোষিত ফাইনালের ঝাঁজ। 

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা আশরাফউদ্দীনের ভাষায়, ‘আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ কী ছিল তা নতুন প্রজন্মের কেউ না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। যখন খেলা হতো, লিগের শেষ ম্যাচ হতো সেটা। দুই দল নিজেদের ম্যাচগুলো জিততে জিততে ফাইনালে উঠতো, যাতে ম্যাচটা পরিণত হতো অঘোষিত ফাইনালে।’ 
 
এ তো গেল কেবল মাঠের কথা। মাঠের বাইরে? এর রেশ থাকতো আরও এক সপ্তাহ, আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ হয়ে যেত বড়সড় উৎসবের উপলক্ষ্য। 

আবাহনী কিংবদন্তি ভাষ্য, ‘ওহহো, সে ম্যাচের আমেজটাই অন্যরকম ছিল। সাতদিন আগে থেকে সারা বাংলাদেশ, সারা ঢাকায়, রাস্তায়, আনাচে-কানাচে প্রচুর আবাহনী মোহামেডান পতাকা উড়তো। পতাকা ওড়াবার, শোডাউনের একটা প্রতিযোগিতা চলতো। দেশ দুই ভাগ হয়ে যেত তখন। এক পক্ষ আবাহনী, আরেকপক্ষ মোহামেডান। আমি মনে করি আবাহনীর যদি চার কোটি থাকত, মোহামেডানের চার কোটি ছিল।’

খ্যাতির পিঠে বিড়ম্বনাও ছিল বৈকি। সে সময় একটা ম্যাচে হার মানে সমর্থকদের বৈরি আচরণের মুখে পড়ার শঙ্কা। সঙ্গে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের দুয়ো তো ছিলই, জানালেন চুন্নু।

সাবেক মোহামেডান ফরোয়ার্ড আলফাজ আহমেদের আবাহনী-মোহামেডান ডার্বি অভিষেকটা ছিল আশরাফউদ্দীনদের অনেক পরে। ১৯৯৫ সালেও দ্বৈরথের ঝাঁজটা ছিল আকাশছোঁয়া। আলফাজ জানালেন, ম্যাচের বিশালত্বটা বুঝেছিলেন খেলা শেষ হওয়ার পর!

বললেন, ‘সেদিন আমার গোলেই আবাহনীকে হারিয়েছিলাম আমরা। ম্যাচটার আগ পর্যন্ত বুঝিনি এর বিশালতা। বুঝলাম ম্যাচ শেষের পর। সমর্থকদের উল্লাসে কান পাতা দায় ছিল স্টেডিয়ামে। মিছিল করতে করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোহামেডান ভক্তরা, উলটো দৃশ্য ছিল আবাহনী সমর্থক-শিবিরে। পরদিন যখন নিজের গোলের উল্লাসটা পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখলাম, বুঝলাম রীতিমতো তারকা বনে গেছি!’

খুব বেশিদিন পেছনে যেতে হবে না। এই ২০০৯ সালে কোটি টাকার সুপার কাপের ফাইনালেও গ্যালারিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়, সমর্থকদের কোলাহলে সেদিন কান পাতা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে।

এরপরই যেন খেই হারাল দ্বৈরথটা। সময়ে সময়ে আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ চলে যায় নিরবে-নিভৃতে। নাবিব নেওয়াজ জীবন কিংবা জাহিদ এমিলিরা গোল করেন, গ্যালারিতে উচ্ছ্বাস করার কেউ নেই! এক সময়ের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ দ্বৈরথের কেন এমন দশা?

চুন্নুর মত, ভালো মানের ফুটবলের অভাব, সঙ্গে মোহামেডানের ব্যর্থতা। বললেন, ‘ফুটবল এমনিতেও পিছিয়েছে বেশ, সঙ্গে মোহামেডানও পিছিয়েছে। দুয়ের মিশেলে ফুটবল থেকে মুখ ঘুরে গেছে মানুষের। মোহামেডান যদি দুয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো, রানার্স আপ হতো, তাহলে ঝাঁজটা থাকতো। নতুন কোনো দলও এখনো সে জায়গা নিতে পারেনি। তার ওপর ভালো ফুটবলের অভাবও আছে। আপনি যদি ভালো ফুটবল খেলতে নাই পারেন, ভালো একটা হেডার, কিংবা ভালো একটা গোল; তাহলে কেন মানুষ আপনার খেলা দেখতে মাঠে আসবে বলেন?’

সাবেক আবাহনী ফরোয়ার্ড শেখ আসলাম যোগ করলেন তৃণমূল ফুটবলের দূর্বলতার কথা। বললেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবলের মান নেমে গেছে। আয়োজন হয়েছে দায়সারা গোছে। এ কারণে পাইপলাইন হয়ে গেছে দুর্বল। যার ফলে এখন আর অতীতের মতো তারকা উঠে আসছে না, যাদের গোল, যাদের নৈপুন্যে দর্শক মুগ্ধ হবে। এজন্যে আবাহনী-মোহামেডান হোক কিংবা দেশীয় ফুটবল, দর্শক মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।’

তবে ফুটবল থেকে সামগ্রিকভাবে যে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, ব্যাপারটা তেমনও নয়। এইতো সেদিন, কুমিল্লায় আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচে মাঠে এসেছিলেন ১৫ হাজার দর্শক। আসলামের সাবেক সতীর্থ চুন্নুর ভাষ্য, ‘মানুষজন ফুটবল থেকে মুখ ফেরায়নি, ঢাকার ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়েছে। ঢাকার বাইরে এখনও ফুটবল বেশ জনপ্রিয়। আবাহনী-মোহামেডানের সমর্থক এখনো সারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।’

সে জনপ্রিয়তা কি আবারও ঢাকার ফুটবলে, আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে ফেরানো সম্ভব? চুন্নুর মত, ‘সম্ভব। যদি এখানে ভালো মানের খেলোয়াড় তুলে আনা যায়। এখানে অনেক দক্ষ খেলোয়াড়ের প্রয়োজন আছে। যাদের নামের কারণে, খেলোয়াড়ী দক্ষতার কারণে আবার দর্শক ফিরে আসবে। তবে মোহামেডানেরও দায় আছে। তাদেরকেও ক্লাব হিসেবে আবার হারানো গৌরব ফেরাতে হবে। তবে যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয়।’

এনইউ/এটি