প্রতিশোধের রবটা প্রথম তুলেছিলেন লিভারপুল ফরোয়ার্ড মোহামেদ সালাহ। নিজেদের ফাইনাল নিশ্চিতের পর বলেছিলেন, ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদকে চান তিনি। পরের দিন মাদ্রিদের ক্লাবটি ফাইনাল নিশ্চিতের পর তো সরাসরি হুঁশিয়ারি তার, ‘আমাদের কিছু হিসাব-নিকাশ বাকি আছে।’

২০১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে হারের ক্ষতে যে এখনো প্রলেপ দিতে পারেননি সালাহ, তার প্রমাণ এই হুঁশিয়ারি। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ওঠা সালাহর আনন্দের উপলক্ষটা যে সেদিন বিষাদময় করে তুলেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। দলটির অধিনায়ক সার্জিও রামোসের বাজে ট্যাকলের শিকার হয়ে মাত্র ৩০ মিনিটেই কাঁধের চোট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে, দলও হেরে যায় ৩-১ গোলে। এরপরের বছরই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই শিরোপা জিতেছিলেন সালাহ, তবে রিয়ালের প্রতি তার ক্ষোভ এতটুকু কমেনি।

রিয়াল মাদ্রিদ ক্যাম্প অবশ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের আগে সালাহর এসব হুঁশিয়ারিকে শুরুতে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। তবে ফাইনালের দিন কয়েক আগে দলটির কোচ কার্লো অ্যানচেলোত্তি প্রতিশোধের পাল্টা হুমকি দিয়ে বসেছেন সালাহকে। তার মতে, প্রতিশোধ তো আগে রিয়ালের নেওয়া উচিৎ। কারণ? ১৯৮১ সালে যে সর্বশেষ লিভারপুলের বিপক্ষেই ইউরোপীয় ফাইনালে হেরেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। প্যারিসের বুকেই সেদিন রিয়ালের হৃদয় ভেঙেছিল লিভারপুল, ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে ১-০ গোলে মাদ্রিদকে পরাভূত করেছিল তারা।

লিভারপুলের বিপক্ষে ফাইনালে সেই হারের পর সাতটি ইউরোপীয় ফাইনালে খেলেছে স্প্যানিশ ক্লাবটি। প্রতিটিতেই জয়ের মুখ দেখেছে তারা। রেকর্ড ১৩ বার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার জিতে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা।

লিভারপুল-ও কম কীসে! ইংলিশ ক্লাবগুলোর মাঝে সর্বোচ্চ ছয়বার ইউরোপসেরা হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে তাদের। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের দিক দিয়ে শুধু ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ ১৩ ও এসি মিলান ৭ শিরোপা নিয়ে তাদের সামনে অবস্থান করছে। লিভারপুলের সমান ছয় শিরোপা নিয়ে তাদের পাশাপাশি রয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ।

এবারের ফাইনালে ওঠার পথটা মসৃণ ছিল না রিয়াল মাদ্রিদ বা লিভারপুল কারও জন্যেই। মাদ্রিদকে তো নকআউট পর্বে রীতিমতো তিন পরাশক্তিকে (পিএসজি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি) পেছনে ঠেলে ফাইনালে পৌঁছুতে হয়েছে। লিভারপুল অবশ্য তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ পেয়েছিল (ইন্টার মিলান, বেনফিকা, ভিয়ারিয়াল)। তবে কীনা একটা কথা প্রচলিত আছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোনো সহজ ম্যাচ নেই। তাই অলরেডদের অর্জনকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই।

রোববার (২৯ মে) রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল দিয়ে অসাধারণ একটা মৌসুমের ইতি টানবে দুই দল। এই মৌসুমে এরই মধ্যে কারাবাও কাপ ও এফএ কাপ জেতা লিভারপুল অল্পের জন্য কোয়াড্রপল বা শিরোপা চতুষ্টয় মিস করেছে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে এক পয়েন্টের ব্যবধানে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা হারিয়ে। অপরদিকে রিয়াল মাদ্রিদ এবার লা লিগা জয় করেছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। নাটকীয় সব প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে পৌঁছে গেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে। দারুণ এই মৌসুম তাই ইউরোপসেরার তকমা সঙ্গী করেই শেষ করতে মুখিয়ে আছে দুই দল।

লিভারপুল আর রিয়াল মাদ্রিদের খেলার ধরনে বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। ইয়ুর্গেন ক্লপের ‘হেভি মেটাল’ প্রেসিং ফুটবলের বিপরীতে অ্যানচেলোত্তির দল খেলে কিছুটা ধীরস্থির ভঙ্গিতে। বেশিরভাগ সময় বলের দখল তাদের পায়ে না থাকলেও সময়মত ঠিকই প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠানোর কাজটা চমকপ্রদভাবে সারে তারা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এবারের আসরে রিয়াল মাদ্রিদের বেশিরভাগ সাফল্যই এসেছে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্যক্তিগত ঝলকে। ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগে যোগ করা সময়ে রদ্রিগো গোয়েজের দুই গোল, চেলসির বিপক্ষে লুকা মদ্রিচের সেই ‘আউটসাইড অব দ্য বুট’ পাস, ম্যান সিটির বিপক্ষেই প্রথম লেগে করিম বেনজেমার পানেনকা শটে নেওয়া পেনাল্টি এবং পিএসজির বিপক্ষে এই ফরাসি স্ট্রাইকারেরই দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক, অবিস্মরণীয় এই মুহূর্তগুলোই অ্যানচেলোত্তির দলকে ফাইনালে তুলেছে।

ক্লপের লিভারপুল বল দখলে রেখে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিরন্তর প্রেসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস তোলে তারা। বেশিরভাগ সময়ই বল আটকে রাখে প্রতিপক্ষের অর্ধে, আর গোলমুখে মুহুর্মুহু আক্রমণ তো চলেই। ফাইনালে দুই দলই খেলতে পারে ৪-৩-৩ ফরমশনে। লিভারপুলের হাইলাইন আর দুই ফুলব্যাক ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসনের আক্রমণে অতি মনোযোগের সুযোগ নিতে পারেন মাদ্রিদের গতিময় উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়র। লিভারপুলের বিপক্ষে রিয়ালের অন্যতম অস্ত্র হতে পারেন তিনি। আর জানুয়ারিতে লিভারপুলে যোগ দেওয়া কলম্বিয়ান ফরোয়ার্ড লুইস দিয়াজ হতে পারেন ক্লপের তুরুপের তাস। ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে তাঁর নৈপুণ্যেই জয়ের দেখা পেয়েছিল অলরেডরা।

এই ম্যাচে ইতিহাস হাতছানি দিচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো অ্যানচেলোত্তি আর স্ট্রাইকার করিম বেনজেমাকে। ফাইনালে যদি লিভারপুলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করতে পারেন এই ফরাসি স্ট্রাইকার, তাহলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর করা এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৭ গোলের রেকর্ড নিজের করে নিতে পারবেন তিনি।

এসি মিলানকে নিয়ে দুইবার এবং রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জেতা রিয়াল কোচ অ্যানচেলোত্তির সামনে সুযোগ রয়েছে লিভারপুলকে হারিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। তিনবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগজয়ী এই ইতালিয়ান এখন ম্যানেজার হিসেবে সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের রেকর্ড ভাগাভাগি করছেন সাবেক রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদান এবং সাবেক লিভারপুল কোচ বব পেইসলির সঙ্গে।

অন্যদিকে এই ম্যাচ জিতলে এরই মধ্যে কারাবাও কাপ ও এফএ কাপ জেতা লিভারপুলের সামনে সুযোগ থাকছে ১৯৯৯ সালের পর প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয়ের।

রোববার (২৯ মে) বাংলাদেশ সময় রাত ১ টায় প্যারিসের স্তাদ দি ফ্রান্সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল, ম্যাচটি সরাসরি সম্প্রচার করবে সনি টেন ২। এছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে ম্যাচটি সরাসরি উপভোগ করা যাবে

সাম্প্রতিক ফর্ম

২০২২ সালে লিভারপুল মাত্র একটি ম্যাচ হেরেছে, গত মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে।

অন্যদিকে চার ম্যাচ হাতে রেখে লিগ শিরোপা নিশ্চিতের পর বাকি ম্যাচগুলোতে মূল একাদশ মাঠে নামাননি রিয়াল কোচ। যার ফলে শেষ চার ম্যাচে মাত্র একটি জয় পেয়েছে তারা, বাকি তিন ম্যাচের দুটিতে ড্র এবং একটিতে হেরেছে। বেনজেমা, মদ্রিচ, ভিনিসিয়াসদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের জন্য এই ম্যাচগুলোতে বিশ্রামের সুযোগ দিয়েছিলেন অ্যানচেলোত্তি। সাম্প্রতিক ফর্মের হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ পিছিয়ে থাকলেও তাই সেটা খুব একটা আশা জোগাবে না লিভারপুলের জন্য।

মুখোমুখি লড়াইয়ে

ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত আটবার মুখোমুখি হয়েছে লিভারপুল ও রিয়াল মাদ্রিদ। চার ম্যাচে ফল গিয়েছে মাদ্রিদের পক্ষে আর তিনটিতে শেষ হাসি হেসেছে লিভারপুল। দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচটি ড্র হয়েছে।

দলের খবর

ফাইনালের আগে লিভারপুলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় চোট শঙ্কায় ছিলেন। তবে দলটির সমর্থকদের জন্য সুখবর, প্যারিসে রোববার রাতে পুরো স্কোয়াডকেই পাচ্ছেন ক্লপ। চোট কাটিয়ে আগেই ফিরেছিলেন ভার্জিল ফন ডাইক ও সালাহ। ফাইনালের আগে চোট শঙ্কা দূরে ঠেলেছেন জো গোমেজ, ফাবিনহো এবং থিয়াগো আলকান্তারাও।

রিয়াল মাদ্রিদ ক্যাম্পে অবশ্য ডিফেন্ডার ডেভিড আলাবা ছাড়া আর কারও চোট সমস্যা ছিল না। ফাইনালের আগে সময়মত আলাবাও সেরে উঠেছেন, তাই ফাইনালে ক্লপের ন্যায় অ্যানচেলোত্তি-ও পূর্ণশক্তির দল পাচ্ছেন।

সম্ভাব্য একাদশ

লিভারপুল : অ্যালিসন, অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ড, কোনাতে, ফন ডাইক, রবার্টসন, হেন্ডারসন, ফাবিনহো, থিয়াগো, সালাহ, মানে, দিয়াজ। 

রিয়াল মাদ্রিদ : কোর্তোয়া, কারভাহাল, মিলিতাও, আলাবা, মেন্ডি, ক্রুস, কাসেমিরো, মদ্রিচ, ভালভার্দে, বেনজেমা, ভিনিসিয়াস জুনিয়র।

এইচএমএ/এটি