‘সান্তিয়াগো বার্নাবিউতে ৯০ মিনিট অনেক বড় সময়’- ১৯৮৪-৮৫ উয়েফা কাপ সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ইন্টার মিলানের কাছে ২-০ গোলে হেরে কথাটা প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের কাছে গিয়ে বলছিলেন রিয়ালের অকালপ্রয়াত স্ট্রাইকার হুয়ানিতো। পরে তার কথাকে সত্যি করে রিয়াল জিতেছিল ৩-০ গোলে।

চলতি মৌসুমে হুয়ানিতোর সেই কথাটাকে যেন নতুন করে প্রমাণ করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। অন্তত চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তো বটেই। নকআউটে প্রতি বার খাদের কিনারে থেকে ফিরেছে কার্লো অ্যানচেলত্তির রিয়াল মাদ্রিদ। একে একে বিদায় করেছে পিএসজি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটির মতো পরাশক্তিদের, পৌঁছে গেছে ফাইনালে। এর পেছনে সান্তিয়াগো বার্নাবিউর দর্শকদের বিশাল সমর্থন আছে বেশ, তবে তার চেয়ে বেশি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে কোচ কার্লোর কৌশল। আজ প্যারিসে লিভারপুলের বিপক্ষে বার্নাবিউর সেই বিশাল সমর্থনটা নেই বটে, তবে অ্যানচেলত্তির কৌশলটা ঠিকই আছে রিয়াল মাদ্রিদের। সেই কৌশলের জোরে আজও যে বর্তে যেতে চাইবেন ইতালিয়ান ভদ্রলোক, তা হলফ করা চলে সহজেই।

ম্যানসিটির বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগের কথা মনে করুন তো! কারিম বেনজেমা যখন রিয়ালের তৃতীয় গোলটা করলেন, তখনো দল পিছিয়ে ৪-৩ গোলে; অথচ দলের উদযাপন দেখে মনে হচ্ছিল, ম্যাচ তো বটেই, লড়াইটাই বুঝি জিতেই গেছে রিয়াল! সে উদযাপনটা কেন ছিল, তা পরের লেগে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে রিয়াল। যোগ করা সময়ে করেছে দুই গোল। এরপর অতিরিক্ত সময়ে আরও একটা। তাতেই পেপ গার্দিওলার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে রিয়াল পৌঁছে যায় ফাইনালে।

এর আগে দুই রাউন্ডের কথা ভাবুন। দ্বিতীয় রাউন্ডে পিএসজির বিপক্ষে লড়াইয়ের চার ভাগের তিন ভাগ সময় রীতিমতো ম্যাচেই ছিল না দলটি, এরপর কারিম বেনজেমার কল্যাণে ভুল করলেন পিএসজি গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডনারুমা, রিয়াল পেলো গোল, এরপরই খেলাটা পিএসজির কব্জা থেকে বের করে ফেলে দলটি। একই কাজ পরে চেলসির বিপক্ষে শেষ আটেও করেছে রিয়াল। এবার অবশ্য প্রতিপক্ষের ভুল থেকে নয়, রিয়াল ম্যাচে ফিরেছে লুকা মড্রিচের সৃষ্টি করা জাদুকরি এক মুহূর্তে। এরপরই কেল্লাফতে। 

টানা তিন রাউন্ডে এভাবে ফিরে আসাকে আর যাই হোক ‘ভাগ্য’ বলা চলে না আদৌ। রিয়ালের ভাগ্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বটে, তবে সেটাকে রিয়ালই ‘কাজ করিয়েছে’। কীভাবে করিয়েছে? এখানেই মুন্সিয়ানা কার্লো অ্যানচেলত্তির। ম্যাচ বিচারে কৌশল সাজানোয় যার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি, সেই তিনিই এখানে কাজ করেছেন নিয়ামক হিসেবে।

রিয়াল মাদ্রিদ প্রতি বারই যখন পিছিয়ে পড়েছে, কোচ কার্লো একটা কাজই করেছেন, প্রতিপক্ষের খেলা ভেঙে দিয়েছেন। প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে প্রাণপণ প্রেস করেছে তার দল, তাতে তড়িঘড়ি করে পাসে গড়বড় হয়েছে বেশ, সেটা কাজে লাগানোর জন্যও সজাগ ছিলেন ম্যান মার্কিংয়ে থাকা রিয়ালের বাকি খেলোয়াড়রা। সব মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছে।

এমন সব কিছুর পর যা রিয়ালকে এগিয়ে দিয়েছে, তা হলো ইন্ডিভিজুয়াল ম্যাচ আপে দলের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেল। মাঝমাঠে মড্রিচ, ক্যাসেমিরো আর সামনে ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা কারিম বেনজেমারা যে বর্তমানে যে কোনো মিডফিল্ডার-মিডফিল্ডার আর স্ট্রাইকার-ডিফেন্ডার দ্বৈরথে সেরা, তা মেনে নেবেন যে কেউই। তরুণ ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রড্রিগো গোয়েজ আর এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গারাও বেনজেমা মড্রিচদের সহায়তা করছেন দারুণভাবে, কখনো কখনো ছাপিয়েও যাচ্ছেন তাদের। রিয়াল কোচের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কৌশল এখানেই দুই দলকে এনে দাঁড় করিয়েছে প্রতি রাউন্ডে। নকআউটের ফিরতি লেগগুলোর মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মুহূর্তগুলো ফিরে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায় বিষয়টা। এখানেই প্রতি লেগে জয়টা পেয়ে গেছে রিয়াল।

তবে সেই রিয়াল এবার মুখোমুখি লিভারপুলের। সেই লিভারপুল যারা ইউরোপের অন্যতম সেরা ‘প্রেস-রেজিস্ট্যান্ট’ দল। কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের দল খেলাটা গড়ে একদম গোলরক্ষক থেকে, প্রতিপক্ষের হরদম প্রেসেও ভড়কে যায় না একটুও। রক্ষণকাজটা সারে ‘স্পেস কভার’ করে, ম্যান মার্ক করে নয়, ফলে আলগা বলেও দখলটা নিয়ে নিতে পারে দ্রুতই। খেলাটা যখন আক্রমণভাগের দখলে আসে, তখন দলটির হয়ে সামনে থাকেন দুই ব্যালন ডি’অর প্রত্যাশী সাদিও মানে আর মোহামেদ সালাহ। ডিয়েগো জোটা, আর দলটিতে নতুন আসা লুইস ডিয়াজরাও অনেকটা ভিনিসিয়াস-রড্রিগোর মতো ভূমিকায় সালাহদের সাহায্য করছেন, কখনো বা ছাড়িয়েও গেছেন বেশ। সব মিলিয়ে লিভারপুল যেন রিয়ালের পুরোপুরি বিপরীত। রিয়াল যেখানে বিশৃঙ্খলাপ্রিয়, সেখানে লিভারপুল বরাবরই বেশ ‘সুশৃঙ্খল’।

তবে এরপরও বেশ কিছু মুহূর্ত এসেছে, যেখানে লিভারপুল গোল খেয়ে হারের দুয়ারে চলে গিয়েছিল প্রায়। সবশেষ উলভারহ্যাম্পটন উলভসের বিপক্ষে ম্যাচটাই তো এর উদাহরণ! এরপরই অবশ্য ‘রিয়াল মাদ্রিদের মতো’ কামব্যাকে জয় তুলে নিয়েছিল ক্লপের দল। পিছিয়ে পড়ে ম্যাচ বের করাটা তাই লিভারপুলও কম জানে না, সেটা চলতি মৌসুমে ভালোভাবেই দেখিয়েছে অল রেডরা। সব মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ-লিভারপুলের ম্যাচআপটা যেন অনেকটাই মিলে যাচ্ছে এক বিন্দুতে, তাতে মিলছে দারুণ এক লড়াইয়ের আভাসও। এই ম্যাচআপে শেষমেশ অ্যানচেলত্তির বিশৃঙ্খলাপ্রিয়তা জিতবে, নাকি ক্লপের সুশৃঙ্খল ফুটবল, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুক্ষণ।

এনইউ/এটি