বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়া। দীর্ঘদিন তিনি জড়িত ছিলেন বাফুফের সঙ্গে। ছবি/ ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতু। ঐতিহাসিক এই সেতুর টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামীম জেড বসুনিয়া। মূলত এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শ ও নির্দেশনাতেই নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন দুই দশকের বেশি সময় ; ছিলেন সদস্য, কোষাধ্যক্ষ ও সহ-সভাপতি। 

২০০২ সালের পর থেকে ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই ড.বসুনিয়ার। ২০০৮ সালের পর বুয়েট থেকে অবসরে গিয়েছেন। এখন নিজের ফার্মে কনসালটেন্সি ও সরকারের বড় বড় প্রকল্পে (পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল) বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। 
এত ব্যস্ততা ও ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্নতার বিশ বছর পরেও তার মনেপ্রাণে সেই ফুটবল ফেডারেশন- ‘আমার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে ফুটবল ফেডারেশন। এটি কখনো ভোলার নয়। দিনের কোনো একটি সময়ে আমার ফুটবল ফেডারেশনের কথা মনে পড়েই।’

ফুটবল ফেডারেশনে দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন এভাবে- ‘ এমনও সময় গেছে  ফেডারেশনে সপ্তাহে প্রতিদিনই গিয়েছি। বাচ্চু ভাই, রহিম ভাই, বাদল, হারুন, হেলাল (আনোয়ারুল হক হেলাল) সবার সঙ্গেই কাজ করেছি। একেকজনের একেক দক্ষতা ছিল। বাচ্চু ভাইয়ের ইংরেজিতে দক্ষতা ছিল অসাধারণ আর বাদলের সংকটময় পরিস্থিতি সামলানো।’ 

নব্বইয়ের দশকে এক সংকটময় ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর শোনা গেল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ক্রিকেটের হবে। তখন বাদলের সাথে আমরা ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ততকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ফুটবলকে বঙ্গবন্ধুতে রাখার অনুরোধ করি।’ প্রধানমন্ত্রী সেই সাক্ষাতে হাতিরঝিলে ক্রিকেট স্টেডিয়াম করার কথা বলেছিলেন। অধ্যাপক ড. বসুনিয়া সেটার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন, ‘‘হাতিরঝিল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য মোটেই উপযোগী নয় এটা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী যাচাই-বাছাই করে আমার বক্তব্যের সত্যতা পেয়েছিলেন। এটা তিনি বুয়েটের সমাবর্তনে এসে আমাদের ভিসিকে জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তিনি কয়েক বছর আগেও আমাকে বলেছেন, ‘আপনার পরামর্শ অনুযায়ী সেখানে ক্রিকেট স্টেডিয়াম করিনি।’’

বুয়েটে চার দশকের বেশি শিক্ষকতা, রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ড.বসুনিয়ার। বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাগত সংগঠনের সঙ্গেও ছিলেন জড়িত। এরপরও তার জীবনের স্মরণীয় অংশগুলো বাফুফেতেই- ‘আগামী বছর ৭৯ বছরে পা দেব। আমার এই দীর্ঘ জীবনে ফুটবল ফেডারেশনে থাকা বিশ বছরকে জীবনের সেরা বলতেই হবে নিঃসন্দেহে। ফুটবল ফেডারেশনে থেকে সমাজ ও জীবনকে দারুণভাবে চিনতে ও জানতে পেরেছি। ফেডারেশনে না থাকতে পারলে হয়তো জীবনের অনেক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাই অপূর্ণ থেকে যেত।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে ফুটবল ফেডারেশনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন স্কুল বন্ধু সাবেক তারকা ফুটবলার ও তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মেজর হাফিজের মাধ্যমে। আশির দশকে ফেডারেশনে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে বসুনিয়া বলেন, ‘হাফিজ আমার ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু। সেই সময় ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন রকিব সাহেব (পুলিশের আইজিপি)। তিনি একদিন হাফিজকে বললেন, ‘ফেডারেশনে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা যায় না। তখন হাফিজ আমাকে বলল ফেডারেশনে আসতে। আমি হাফিজকে বুয়েটে চিঠি দিতে বলি। বুয়েটের ভিসি আমার নাম ফেডারেশনে পাঠায়। এভাবেই ফেডারেশনের সাথে জড়িয়ে পড়া।’

১৯৮২ সালের পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ফেডারেশনের বিভিন্ন পদে ছিলেন। ১৯৮৪ সালে প্রথম সাফ গেমসে জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন। এরপর কয়েকবার ম্যানেজার ও দলনেতাও হয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় দল একবারই ইউরোপ সফর করেছে। ২০০০ সালে সেই ইংল্যান্ড সফরে ড.বসুনিয়া ছিলেন দলনেতা। সহ-সভাপতি থাকায় অনেক সময় সভাপতির অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সভায় সভাপতিত্বও করেছেন। 

ফুটবল ফেডারেশন ছাড়াও নিজের প্রতিষ্ঠান বুয়েটের খেলার প্রসারেও রয়েছে তার যথেষ্ট ভূমিকা। বেশ কয়েক বছর বুয়েটের শারীরিক শিক্ষা অফিসের উপদেষ্টা ছিলেন। বুয়েটের উপ-পরিচালক ও দেশের ফুটবল কোচ মারুফুল হকের খ্যাতি পাওয়ার পেছনেও রয়েছে বসুনিয়ার যথেষ্ট অবদান।

বুয়েটকে বিদায় জানানোর দিনে শিষ্যদের ভালোবাসা/ঢাকাপোস্ট

বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে এখন মতিঝিলের নতুন ভবনে। সেই ভবনের পরিকল্পনাও তার করা- ‘বিল্ডিংয়ের স্থান এবং এর সামনে বেশ বড় জায়গা রাখার পরিকল্পনা আমারই।’ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা করলেও স্বার্থের সংঘাত এড়াতে ফেডারেশনের নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ নিজে করেননি। ফুটবল ফেডারেশন ভবনের কাজ না করলেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার কাজ করেছেন। এখন চলমান ১০০ কোটি টাকা অধিক সংস্কার প্রকল্পে শেড অংশটি হচ্ছে তার নির্দেশনায়।

ফুটবল সংগঠক হলেও ক্রিকেটেও রয়েছে তার অবদান। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ড্রেনেজ সিস্টেম, মিডিয়া বক্স হয়েছে তার নির্দেশনায়- ‘ক্রিকেট বোর্ডে প্রথমে আমি সম্পৃক্ত হতে চাইনি। মাহবুব আনাম (ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক) অনুরোধ করল, ‘স্যার আপনি শুধু ফুটবল নয়, ক্রীড়াঙ্গনের লোক।’ মাহবুব আমার বুয়েটের সরাসরি ছাত্র হওয়ায় ক্রিকেট স্টেডিয়াম সংস্কার নির্দেশনায় যুক্ত হই।’ মিরপুর স্টেডিয়ামের ড্রেনেজ সিস্টেম বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের মধ্যেও সেরা। 

২০০২ সালের পর থেকে ফুটবল ফেডারেশন ও ফুটবলের সঙ্গে আর না থাকার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে নির্বাচন শুরু হয়। একবার সহ-সভাপতি নির্বাচন করে জিতেছিলাম। ২০০২ সালের পর সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচন করে হেরে যাই ( মোহামেডানের মুনীরের বিপক্ষে)। নির্বাচন, ভোটাভুটি করে ফেডারেশনে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আর সম্পৃক্ত থাকা হয়নি।’

নির্বাচন করে নির্বাহী কমিটিতে না থাকলেও স্ট্যান্ডিং কমিটিতে রাখার সুযোগ থাকে। গত বিশ বছরে বাফুফের কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটিতেই তাকে রাখা হয়নি। এমনকি ফুটবলের বড় কোনো অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানানো হয় না এই কৃতি ব্যক্তিত্বকে। গত এক দশকে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক বুয়েটেরই সাবেক ছাত্র। পেশাদার সাধারণ সম্পাদক হলেও ফেডারশেনের প্রায় সব কিছুই তার তত্ত্বাবধানেই হয়। তারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বরেণ্য এ ফুটবল ব্যক্তিত্বকে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কোনোদিন স্মরণ করা হয়নি। ফুটবল ফেডারেশনে ‘জাতীয় দলে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছে কে’- সেই রেকর্ডই নেই, সেখানে সাবেক কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন প্রত্যাশা করাটা তো দুরাশাই!

দেশের শীর্ষ প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ; এরপরও খুব সাধারণের মতো চলাফেরা। তার নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনেক অখ্যাত জায়গা বিখ্যাত হয়েছে। সেই ব্যক্তির ঢাকা শহরে কোনো জমি নেই, ‘আমার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে; সেটাই যথেষ্ট। আমার বাবা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তারও কোনো প্লট ছিল না, আমারও নেই। জীবনকে আমি খুব সহজ করেই ভাবি।’ বসুনিয়ার অনেক ছাত্র দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি, অর্থ-বৈভব। এসব নিয়ে ভাবেন-ই না তিনি। উল্টো ফুটবল থেকে পাওয়া সম্মানই তার বড় পাওয়া, ‘কিছু দিন আগেও রাস্তায় আমাকে দেখে জনি (ইমতিয়াজ সুলতান জনি সাবেক জাতীয় অধিনায়ক) গাড়ি থামিয়ে নেমে স্যার স্যার বলে সালাম দিল। যে জনিদের এক নজর দেখার জন্য লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষা করত। সেই জনিদের মতো আরো অনেক ফুটবলার আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে ও সম্মান করে। যার কোনো মূল্য হয় না।’

সাদামাটা জীবন যাপনের পাশাপাশি তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিনয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথমে জামিলুর রেজা চৌধুরি। তিনি ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান। জামিলুর রেজা চৌধুরির প্রয়াণের পর তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর অগ্রজকে স্মরণ করলেন এভাবে, ‘জেআরসি ( জামিলুর রেজা চৌধুরি) স্যার হলেন জ্ঞানের মহাসমুদ্র। তার সাথে থাকতে পারাটাই ছিল আমার জন্য অনেক। তার সমকক্ষ কেউ নেই।’ অগ্রজের সম্মানের পাশাপাশি নিজের জনপ্রিয়তাকে ঢাকতে এই ঢাল ব্যবহার করেন অনেক সময়,‘ মানুষজন অনেকেই বলে স্যার আপনার ছবি দেখেছি, আপনাকে নিয়ে লেখা পড়লাম। আমি বলি কই আমি না তো, আমার মতো দেখতে যমজ ভাই (হাসি)।’

স্ত্রীকে হারিয়েছেন প্রায় এক বছর। এক মাত্র কন্যা চার বছর আগে ব্লাড ক্যান্সারে পরপারে। পরিবারের বলতে আছে একমাত্র ছেলে ও ছেলের পরিবার।

বয়স আশি হলেও এখনো অত্যন্ত কর্মক্ষম বসুনিয়া। দিনে আট-দশ ঘণ্টা নিজের অফিস করেন। সরকারের নানা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে সময় দেন। এর ফাঁকে যতটুকু সময় পান ততটুকু খেলা দেখেই কাটান। বিশেষ করে ফুটবল দেখে এই বয়সেও অনেক রাত নির্ঘুম কাটান তিনি।

এজেড/এটি/এনইউ