কৃষ্ণা রাণী সরকার ও তার স্বজনরা/ ছবি- সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের গোপালপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পাথালিয়ার এক কৃষকের কন্যা কৃষ্ণা রাণী সরকার। সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের এ সদস্য ফাইনালে করেছেন মূল্যবান দু-দুটি গোল। তার গোলেই বিজয় নিশ্চিত করে সাবিনারা। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ফুটবল নিয়ে কৃষ্ণার পায়ের জাদুকরি একটি মুহূর্তের ভিডিও।

অদম্য সেই কৃষ্ণার অপেক্ষায় রয়েছেন বাবা-মা, স্বজন ও গ্রামবাসী- কখন আসবে ফুটবলকন্যা তার গ্রামের বাড়িতে।

মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে কৃষ্ণাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের মানুষ কৃষ্ণাদের বাড়িতে আসছেন খুশির খবর দিতে এবং নিতে। তার বাবা বসুদেব সরকার ও মা নমিতা রাণী ব্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে। এছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকরাও একে একে বাড়িতে হাজির হচ্ছেন।

জানা গেছে, কৃষ্ণা রাণী সরকার অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা দলের অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক গল্প-কাহিনী। গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরও তার এমন সাফল্য সবার প্রশংসা পাচ্ছে। এক সময় যারা সামাজিক কুসংস্কারের ধুয়া তুলে মেয়েদের ফুটবল খেলা অপছন্দ করতেন, তারাই এখন কৃষ্ণার সাফল্য দেখে গর্ব করছেন।

গোপালপুরের পাথালিয়া গ্রামের অনেকেই বলেন, কৃষ্ণা শুধু গ্রামের নারী ফুটবলার নয়, সে সারা দেশের ফুটবলার। দেশের গৌরব। এই গৌরবে গৌরবান্বিত গ্রামের মানুষ। খেলার দিন এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় অন্য এলাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়। তার জোড়া গোল এবং খেলা খুবই ভালো লেগেছে। নেট দুনিয়ায় তার খেলার কিছু খণ্ডচিত্র ভাইরাল হয়েছে। টেলিভিশন খুললেই কৃষ্ণা ও তার দলের খেলোয়াড়দের দেখা যায়।

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার

কৃষ্ণার কাকা নিতাই সরকার বলেন, কৃষ্ণাকে ছোট থেকেই উৎসাহ দিয়েছি। সংসারে অভাব ছিল, তারপরও ওর খেলা বন্ধ করিনি। স্থানীয় বাপন স্যারের মাধ্যমে কৃষ্ণা বিনামূল্যে পড়াশুনা ও খেলাধুলা করার সুযোগ পায়। প্রথমে স্কুলভিত্তিক প্রতিযোগিতা, পরে জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায় সে। এভাবেই সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে গেছে। আজ সে দেশের সুনাম অর্জন করেছে এতে আমরা স্বজনরা যেমন খুশি তেমনি গ্রামের মানুষজনও অনেক খুশি।

কৃষ্ণার খেলার সহপাঠী সামিরা আখতার পলি বলেন, কৃষ্ণার খেলা দেখে আমিও তার সাথে ফুটবল খেলতে শুরু করি। প্রথমে ইউনিয়ন পরে উপজেলা- জেলা পর্যায়ে খেলায় অংশ গ্রহণ করেছি। পরে পারিবারিক চাপের কারণে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে কৃষ্ণা হাল ছাড়েনি। সব বাধা অতিক্রম করে সে এগিয়ে গেছে। আজ কৃষ্ণাকে নিয়ে দেশের মানুষ গর্ব করছে। এটা দেখে অনেক ভালো লাগছে। সে আরো এগিয়ে যাক এবং এমন জয়ের ধারা অব্যাহত রাখুক, এই কামনা করি।

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার বলেন, আমার এক মেয়ে ও এক ছেলে। কৃষ্ণা বড়। যখন কৃষ্ণা ফুটবল খেলত এলাকায়, তখন মানুষ এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। মেয়ে মানুষ কেন ফুটবল খেলবে, এটা ঠিক না- এসব বলত। কিন্তু তারাই এখন কৃষ্ণার সাফল্যের কথা বলছে। মেয়ে বিদেশে খেলায় অংশগ্রহণের জন্য যাওয়ার পর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি। এখনও কথা হয়নি। তবে আমার ছেলের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় কৃষ্ণার। তার আসার অপেক্ষার দিন গুনছি।

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার বলেন, ফাইনাল খেলা যখন শুরু হয়, তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে গিয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে খেলা দেখি। অনেক মানুষের ভিড়ে মেয়ের খেলা উপভোগ করেছি। খুব আনন্দ লেগেছে। মানুষও আমাকে অনেক অভিনন্দন জানিয়েছে। অনেকে তখন বলছে, কৃষ্ণার বাবার সঙ্গে বসে আমরা খেলা দেখছি। মেয়েটার সঙ্গে অনেক দিন হলো কথা বলতে পারছি না। বড় মোবাইল (এন্ড্রয়েট) না থাকাতে তাকে যেমন দেখতেও পারছি না ,তেমনি কথাও বলতে পারছি না। এখন অপেক্ষায় আছি- কখন এসে সে বলবে, বাবা আমি দেশের জন্য বিজয় অর্জন করেছি।

কৃষ্ণার স্কুল কোচ গোলাম রায়হান বাপন বলেন, কৃষ্ণার হাত ধরেই এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন হয়েছে। কৃষ্ণা খুবই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। আজ সে দেশসেরা নারী ফুটবল খেলোয়াড়। দেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছে সে। এতে শিক্ষক হিসেবে আমি গর্বিত। তাকে দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হবে। মেয়েরা এই জয়ের ধারা বজায় রাখবে এটাই প্রত্যাশা করি।

গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুছ ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু বলেন, ২০০৯ সালে চেয়ারম্যান হওয়ার পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার আয়োজন করতাম। বাংলাদেশে প্রথম প্রাইমারি পর্যায়ের ফুটবল খেলায় সারা দেশে প্রথম স্থান অর্জন করে গোপালপুর। কৃষ্ণাকে যখন ফুটবল কিনে দিই তখন তাদের গ্রামের বাড়ি পাথালিয়া এলাকায় মাঠে খেলা হতো। তখন অনেকেই বলত উপজেলা চেয়ারম্যান কেন মেয়েদের দিয়ে ফুটবল খেলাচ্ছে। তারপরও আমি কৃষ্ণাকে খেলাধুলার সামগ্রী কিনে দিয়েছি। এরপর টিম দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। আমার আনন্দ একটাই, কৃষ্ণা এখন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্জন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এটি/জেএস