বাবা-মায়ের সঙ্গে আঁখি খাতুন

সিরাজগঞ্জের মেয়ে তাঁত শ্রমিক কন্যা নারী ফুটবলার আঁখি খাতুন এখন জেলার সকলের নয়নের মণি। নানা অভাবে বেড়ে ওঠা আঁখি এখন অনেক মেয়েরই আদর্শ। আঁখির পরিবার, বন্ধু-বান্ধবীসহ স্থানীয়রা বলছেন, আঁখিদের মতো গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই এখন দেশের নাম ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বজুড়ে। আর আঁখিরা যখন দেশের নাম উচ্চ শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন তখন আঁখিকে নিয়ে গর্বিত তার তাঁত শ্রমিক বাবা ও গৃহিণী মা। বলছেন সে শুধুর দেশের নয় স্বপ্ন পূরণ করেছেন আমাদেরও।

নারী সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ নারী ফুটবলের শিরোপা জয়ে দেশবাসী এখন আনন্দিত ও উল্লাসিত। একই আনন্দ চলছে আঁখির জন্মভুমির বাড়িতেও। জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের তাঁত শ্রমিক আক্তার হোসেন ও নাছিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের ছোট আঁখি।

শিরোপা জয়ের পর শাহজাদপুরের আখিঁসহ তার পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন বাহবা। এই বাহবার পেছনে রয়েছে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ। আঁখির গ্রামে যারা অতীতে কটুকথাসহ নানা ধরনের নৈতিবাচক মন্তব্য করতেন, তারাই এখন আঁখিসহ তার পরিবারকে নিয়ে প্রশংসা করছেন, জানালেন আঁখির হাতেখড়ি দেওয়া শিক্ষাগুরু পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. মনসুর রহমান।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক মনসুর রহমানের সহযোগিতায় দরিদ্র তাঁত শ্রমিক আকতার হোসেনের মেয়ে আখিঁ প্রথমবারের মত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবলে অংশ নেয়।  প্রথমে উপজেলা, জেলা, রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায় ও অতঃপর ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে।


 
এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি আাঁখিকে। অনুর্ধ ১৫ জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পায় আঁখি। নারী হয়ে ফুটবল খেলেন বলে এক সময় গ্রামবাসী তাকে কটুকথা ও অনেক ধরনের নৈতিবাচক মন্তব্য করেছেন। সেই তারাই এখন আঁখিকে বাহবা দিচ্ছেন, করছেন প্রশংসাও। কারণ আঁখি এখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের তারকা খেলোয়াড়। গত ডিসেম্বরে ভারতকে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল সবুজের দল। এরপরে আবার এই বিজয়।

আঁখির বড় ভাই নাজমুল ইসলাম বলেন, আমাদের সংসার এখন সুখের। আমাদের আর কোন কষ্ট নেই। আগে আমাদের অভাব ছিলো। মা মাঝে মধ্যেই আশ-পাশের বাড়িসহ নানা বাড়ি থেকে চাল-ডাল চেয়ে  আনতো। এখন আর আনতে হয় না। এছাড়াও আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত।

স্থানীয় আঁখির বান্ধুবি মনোয়ারা, তিশা ও উর্মি জানান, আমরা আঁখির সঙ্গেই পড়েছি। ও ছোট বেলা থেকেই ফুটবল, দৌড় ও জাম্পিং খেলায় প্রথম হতো। আঁখিকে নিয়ে আমরা গর্ব করছি। আখিঁ আমাদেরসহ দেশ ও সকলের গর্বিত সম্পদ।

পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন হোসেন জানান, ২০১১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবল খেলা শুরু হয়। পরের বছর আখিঁকে নিয়ে দল গঠন করেন সহকর্মী মুনসুর রহমান। তিনি নিজেও একজন সাবেক ফুটবলার ছিলেন।

তাঁত শ্রমিক আখিঁর বাবা আকতার হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মনসুর স্যার এবং ইব্রাহীম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের লাকী ম্যাডাম আমার মেয়ে আখিঁকে প্রচন্ড সহযোগিতা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশপাশি ওই দু'জন শিক্ষকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আখিঁর জন্য আজ আমি গর্বিত ও সম্মানিত। তিনি বলেন, এর আগে প্রধানমন্ত্রী উপহার হিসেবে আমাদের ১৫ লাখ দিয়েছেন। সে অর্থ দিয়ে আমি জমি কিনে চাষাবাদ করে সংসার চালাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ইউএনও সাহেব এসেছিলেন, তিনি বললেন আখিঁ ফিরলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সাবেক এমপি চয়ন সাহেবও তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য খোজ নিচ্ছেন। আমি সত্যিই আজ অনেকবেশি গর্বিত। তার এসকল কথার মাঝে আবেগী হয়ে বার বার কেপে উঠছিল গলা।

ইব্রাহীম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার জানান, নারী ফুটবলের জয়ের পেছনে আছে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট। আঁখির উঠে আসা এই টুর্নামেন্ট দিয়েই। ২০১৪ সালে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পর বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলে আঁখি। এরপরে নাম লেখায় বিকেএসপিতে। সেখান থেকে ডাক পায় ২০১৫ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ গ্রহণকারী বাংলাদেশ দলে। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আখিঁ, পারভীন, জেসমিনসহ ১২ জনকে নিয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুন নাহার লাকী নারী ফুটবল খোলোয়ারদের একটি দল গঠন করেন। এর মধ্যে ৮ জন বিকেএসপিতে সুযোগ পেলেও অন্যান্যরা ঝড়ে পড়ে। এত দারিদ্রদার মধ্যেও তাঁত শ্রমিক কন্যা আখিঁ দমেনি।

জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল হাসান হিলটন জানান, নারী ফুটবলার আঁখি সিরাজগঞ্জের গর্বিত সন্তান। তাদের পুরো খেলা আমি মাঠেই দেখেছি। মুহুর্তের ভিতরে ওভারলেকিং ছাড়া লং পাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে সবসময় চাপে রেখেছিল। তার এই অসামান্য অবদানে জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা আঁখিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, আখিঁ একজন ডিফেন্ডার। তার উচ্চতাও অনেক ভালো। তার কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে বা তাকে পাস করে পেনাল্টি এরিয়ায় ঢুকে গোল করা কঠিন। সেই সাথে আখিঁ ওভারল্যাপও ভাল করতে জানে। ওভারল্যাপ করে ছিনিয়ে আনতে পারেন গোলও।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ বাংলাদেশের মানুষ একত্রিত হয়ে আনন্দ করছে। আমরা সবাই আজ আনন্দিত ও সবাই আজ আনন্দ উল্লাস করছে। এর মাঝে যেহেতু আখিঁ আমাদের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সন্তান তাই আমাদের আনন্দটা আরও বেশি। এই আনন্দ প্রকাশ করার ভাষা আসলে প্রকাশ করার মত নয়। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত।

তিনি ঢাকা পোস্টকে আরো বলেন, তাকে নিয়ে আমাদের উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের নানান পরিকল্পনা রয়েছে। আমি নিজে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তার আসতে হয়তো কয়েকদিন দেরি হবে। রাতে আমি আঁখির সঙ্গে কথা বলবো। আমরা তাকে অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানাবো, তার সঙ্গে এই বিজয় উদযাপন করবো। এর অংশ হিসেবে আমরা ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট আঁখির ফুটবলে হাতেখড়ি। এর পরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায়। এখন জাতীয় দলের হয়ে খেলছে। বর্তমানে আঁখির খেলার মান অসাধারণ। সাফের শিরোপা লড়াইয়ে দেশের হয়ে অবদান রাখায় আমরা আনন্দিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামীতে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

এটি