মারিয়া মান্ডার মা এনতা মান্ডা। ১৪ বছর আগে হারান স্বামী বীরেন্দ্র মারাককে। তারপর তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে মানুষ করার দায়িত্ব আসে তার ওপরই। বাবা নেই সেটি বোঝারও তখন বয়স হয়নি ছোট্ট মারিয়ার। সহায়-সম্বলহীন এনতা মান্ডা সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে শুরু করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ। তাদের মানুষ করার স্বপ্নে নাও ভাসান জীবনের উত্তাল সমুদ্রে। 

মারিয়া মান্দার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ গামারিতলা ইউনিয়নের মন্দিরকোনা গ্রামে। গ্রামটি কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েরর পাশেই। নৌকায় নেতাই নদী পার হয়ে যেতে হয় মারিয়াদের বাড়িতে। সেখানে শ’খানেক মান্দি পরিবার রয়েছে। মারিয়া এখন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বর্তমানে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। 

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পড়া অবস্থায় ফুটবলে পা পড়ে মারিয়ার। বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের সহযোগিতায় চলতে থাকে নিয়মিত অনুশীলন, ট্রেনিং সেশন। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে খালি পায়ে শুরু হয়েছিল মারিয়ার ফুটবল খেলা। ২০১৩ সালে সেই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তারপরই মারিয়ার পায়ে ওঠে বুট। আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে মারিয়ার পৃথিবী। 

২০১৪ সালে অনুর্ধ্ব-১৪ দলে ডাক পান মারিয়া। এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশীপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, সে দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন মারিয়া। ২০১৭ সালে ঢাকায় অনুর্ধ্ব-১৫ সাফে মারিয়ার নেতৃত্বেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। পরের বছর এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন মারিয়া। শিলিগুড়ি সাফে বাংলাদেশের রানার্সআপ হওয়ার পেছনেও ছিল মারিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সব বাধা পেরিয়ে যেন রূপকথার গল্পই লিখে চলেছেন সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য। 

কলসিন্দুর বাজারের একটি দোকানে টেলিভিশনে মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখেই এনতা মান্ডা স্বপ্ন বুনেছিলেন নিজের মেয়েকেও একদিন এভাবেই দেখবেন। মায়ের সেই স্বপ্ন মনে লালন করেছিলেন মারিয়াও। তবে চলার পথটা ছিল খুবই কঠিন। তবে কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে সেই পথটা মসৃণ করেছেন মা এনতা আর বড় দুই বোন হাসি ও পাপিয়া মান্ডা। সেই ছোট্ট মারিয়া আজ পুরো দেশের গর্ব।  

গারোপাহাড় বেয়ে আসা নেতাই নদী পার হয়ে মারিয়া মান্ডার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সকলের মুখে হাসির ঝিলিক। টিনশেডের ঘর থেকে মারিয়ার ছবি আঁচলে মুছতে মুছতে বের হন মা এনতা মান্ডা। মেয়ের জন্যে আনন্দে আজ আত্মহারা। সেই সঙ্গে শোনান মেয়ের কষ্টের গল্পও। খেলায় বিজয়ী হওয়ার পরই মা ও বোন পাপিয়া মান্ডার সঙ্গে কথা হয় মারিয়ার। নিজের জয় মা-বোনদের উৎসর্গ করে দোয়া চেয়েছে সে। 

এনতা মান্ডা বলেন, অভাবের সংসারে তিন বেলা খাবার দিতে পারিনি মেয়েকে। তবুও অনেক কষ্ট করে প্রতিদিন প্রেক্টিসে গিয়ে খেলা শিখেছে। আজ দেশের জন্য আনন্দ এনেছে মেয়ে। 

চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া আনন্দাশ্রু মুছতে মুখে মারিয়ার মা আরও বলেন, পাপিয়ার মোবাইলে মারিয়ার খেলা দেখেছি সবাই মিলে। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কাপ নিয়ে ফিরেছে। সব কষ্টই আজ ভুলে গেছি। সবাই খুব আনন্দিত হয়েছি। 

মারিয়ার বোন পাপিয়া মান্ডা ছোট বোনকে খেলায় দেওয়ার পরই খরচ সংসার চালাতে ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। অনেক বছর গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালানোর পর মাস ছয়েক আগে বাড়ির সামনে একটি দোকান দিয়েছেন। সেই দোকানে বসে কথা হয় পাপিয়ার সঙ্গে। পাপিয়া বলেন, মারিয়া অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে খেলা চালিয়ে গেছে। আমরা যতদূর পেরেছি সাহায্য করেছি। এখন মারিয়াই সংসারের অনেক কিছু দেখা শোনা করে। 

মারিয়ার প্রতিবেশী আবুল কালাম বলেন, খুব কষ্ট করে মারিয়ার পরিবার। শুরুতে মানুষ কটুকথা বললেও মারিয়াদের কৃতিত্বে দেশ আজ গর্বিত। আমরাও এলাকাবাসী হিসেবে গর্বিত।

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের হাত ধরেই ফুটবলে হাতেখড়ি হয় মারিয়া মান্ডার। মারিয়ার আজকের এই সাফল্যে গর্বিত এই শিক্ষক। মফিজ উদ্দিন বলেন, মারিয়ার মাঝে শুরু থেকেই  ফুটবলের প্রতি আগ্রহ-ভালোবাসা দেখেছি। ফুটবলটা অন্যান্যদের চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলেছিল মারিয়া। শত কষ্ট, বাধা-বিপত্তি স্বত্ত্বেও চালিয়ে গেছে ফুটবল খেলা। সেই কষ্ট জয় করা মারিয়া আজ সকলের মন জয় করেছে প্রতিভার ঝলক দেখিয়েই। তার ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা।

এটি