সাফজয়ী ফুটবলকন্যাদের জয়োৎসবের রেশ এখনো কাটেনি। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সংবর্ধিত হয়েছেন সাফ জয়িতারা। দীর্ঘ ১৯ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে শিরোপা হাতে দেশে ফেরা কন্যাদের ছাদখোলা বাসে রাজসিক সংবর্ধনায় দেশ জুড়ে চলছে জয়গান।

এবার সেই কন্যারা ফিরবে নিজ নিজ গ্রামে। আজ বুধবার থেকে ছুটি মিলছে তাদের। বাড়ি ফেরা এই বিজয়ী দলের একজন রংপুরের সিরাত জাহান স্বপ্না।

১০ নম্বর জার্সি পরিহিত স্বপ্নার পায়ের জাদুতে ভারতকে প্রথমবারের মতো পরাজিত করে স্বপ্নজয়ের স্বপ্ন দেখে দুষ্টু হয়েছে কেন দুষ্টু পচাবে।ছিলেন সাবিনারা। ভারত বধের পর সেমিতে ভুটান এবং ফাইনালে নেপালকে পরাস্ত করে বাংলার মেয়েরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। সেই সেরাকন্যাদের বাড়ি ফেরার খবরে ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, রাঙ্গামাটি, ঠাকুরগাঁওয়ের মতো রংপুরেও চলছে উৎসবের প্রস্তুতি।

সাফ জয়ের ১০ দিন পর ছুটির ঘণ্টা বাজায় রংপুরে আগামীকাল বৃহস্পতিবার পা রাখবেন সিরাত জাহান স্বপ্না। বিশ্বদরবারে বাংলার বিজয় পতাকা উড়ানো সাফজয়ী স্বপ্নাকে বরণ করতে এখন উন্মুখ রংপুরবাসী। সংবর্ধনা জানাতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা প্রশাসন। গরু জবাই করে সংবর্ধনা উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এলাকাবাসী।

ইতোমধ্যে সিরাত জাহান স্বপ্নাকে বরণ করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচি। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে সিরাত জাহান স্বপ্নাকে অভ্যার্থনা জানানো হবে। তারপর সেখান থেকে স্বপ্নাকে নিয়ে গাড়িবহরে রংপুর নগরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করা হবে। এ যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে স্বপ্নাকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করবেন ক্রীড়া সংগঠনগুলোসহ ফুটবলপ্রেমী রংপুরের মানুষ।

পাবলিক লাইব্রেরী মাঠের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে স্বপ্না ফিরবেন সদ্যপুষ্কুরিনী ইউনিয়নের নয়াপুকুর জয়রাম গ্রামে। এই গ্রামই তার আপন ঠিকানা। সেখানে তাকে লালগালিচায় বরণ করে নেবেন গ্রামবাসী। পরে দেশের একমাত্র নারী ফুটবলাদের জন্য নির্মিত শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে স্বপ্নার সম্মানে প্রীতি ম্যাচ খেলবেন সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়রা।

প্রীতি ম্যাচ শেষে সিরাত জাহান স্বপ্নাকে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, সদ্যপুষ্কুরিনী ইউনিয়ন পরিষদ এবং সকল রাজনৈতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে গণসবংর্ধনা দেয়া হবে। সেই সাথে সংবর্ধনা শেষে গরু জবাই করে খাওয়ানোর প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছেন কয়েকজন গ্রামবাসী।

রংপুর শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁ পালিচড়া জয়রাম গ্রামে স্বপ্নার বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে ইতোমধ্যে স্বপ্নার পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুর নাহার বেগম ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসিমা জামান ববি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে। স্বপ্নাকে বরণ করতে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য তাঁরা এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসিমা জামান ববি বলেন, পালিচড়া গ্রামের নারী ফুটবল খেলোয়াড়দের শুরু থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে আসছে উপজেলা পরিষদ। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে স্বপ্নার পরিবারকে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে রংপুর জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি মঞ্জুর আহমেদ আজাদ সাফজয়ী স্বপ্নাকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ওই পুরস্কারের চেক হস্তান্তর করা হবে।

সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেন কোচ মিলন খান রাজ। তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন জেলা শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ নারী ফুটবলারদের এই গ্রামে বেড়াতে আসছেন। স্বপ্নাসহ অন্য মেয়েদের খেলাধুলার খোঁজখবর রাখছেন। মানুষের আগের ধারণার এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমরা স্বপ্নাকে লাল গালিচা দিয়ে বরণ করব। সঙ্গে তার সম্মানে প্রীতি ফুটবল ম্যাচের প্রস্তুতি হিসেবে শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে মেয়েদের অনুশীলন চলছে।

এদিকে সিরাত জাহান স্বপ্নার ফুটবল নৈপুণ্যে উদ্বেলিত মা লিপি বেগম। তিনি বলেন, টিপিত খেলা দেকি মনটা জুড়ি গেইছে বাহে। এ্যলা তো প্রত্যেকদিন স্বপ্নাক টিপিত দেখা যায়। আল্লাহ হামার দেশের মান থুইছে। ছাওয়ারা সবায় ভালো খেলছে। বিদেশের মাটিত বাংলাদেশের নাম হওছে, এটাতো বিশাল আনন্দের।

তিনি আরও বলেন, স্বপ্না মেলা দিন পর বাড়িত আইসোছে। এই আনন্দোতে মোর রাইতোত ঘুমে হয়ছে না। গ্রামবাসীও অনেক আনন্দ করবে। মোর ছাওয়াটাক দেখার জন্য সবায় অধীর আগ্রহে আছে। স্বপ্নার দুই বোনের জামাইরাও বরণ করি নেবে। স্বপ্না বাড়িত আসলে পছন্দের খাবার শুঁটকি ভর্তা দিয়া গরম–গরম ভাত খাইবে। ভুনা গরুর গোশত খাইবে। স্বপ্নার পছন্দের নানা পদের শাকও রান্না করা হইবে।

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী সিরাত জাহান স্বপ্নারা তিন বোন। তাঁর বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। স্বপ্নার বাবা মোকছার আলী একসময় বর্গাচাষি ছিলেন। আর মা লিপি বেগম অভাব অনটনের সংসারে সন্তানদের মুখে একবেলা ভাত তুলে দিতে করেছেন ধান ভাঙার কাজ। তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকোও ছিল না। সেই কষ্টের সংসারে স্বপ্না যেন ভাঙ্গাঘরে চাঁদের আলো হয়ে এসেছেন। 

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ের  ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্ণামেন্টের মধ্যদিয়ে স্বপ্নার আত্মপ্রকাশ। এরপর তার ক্রীড়া নৈপুণ্যে নজর পড়ে বাফুফের। সিরাত জাহান স্বপ্না ২০১৩ সালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পায়, সেই থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলছেন। এবার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ৪ গোল করে দেশের জয়ে ভূমিকা রেখেছেন স্বপ্না। এই চার গোলের মধ্যে দুটিই ছিল ভারতের জালে। 

এটি