বাংলাদেশ ফুটবল দল নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে। সেটাও আবার কখনো হারাতে না পারা নেপালকে তাদের মাটিতে হারিয়ে। বাংলাদেশের ফুটবলে আগে কখনো এমন উৎসবের অর্জন হয়নি। বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বও ছুঁতে পারেনি। আর এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতায় স্বপ্ন চওড়া হয়েছে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী ফুটবলারদের। 

গ্রামের মেয়েরা খেলাধুলা করবে, তাও আবার ফুটবল! মাত্র এক বছর আগেও এমন কথা কল্পনাও করতে পারেনি এলাকার মানুষ।  কিন্তু এখন তারা সেই কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের মেয়েদের চোখেমুখে এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জেতার পর গ্রামের এই ক্ষুদে নারী ফুটবলারের স্বপ্ন এখন বাংলাদেশের হয়ে নারী ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার। 

নারী ফুটবলারদের গ্রাম এখন পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পুকুরিয়া গ্রাম। এখানকার একদল মেয়ে এখন ‘ফুটবল কন্যা’। পারিবারিক দরিদ্রতা আর সামাজিক কুসংস্কারের শেকল ছিঁড়ে তারা এগিয়ে যেতে চায় বহুদূর। সেই লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত চলছে কঠোর অনুশীলন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক আর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মেয়েদের সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখাতে চান তারা। আর এতে আগুনে ঘি দেয়ার মতো কাজ করেছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। 

পারিবারিক অভাব-অনটন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি মেয়েদের। গত এক বছরে নিয়মিত অনুশীলন এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ইতোমধ্যে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে তারা। এলক্ষ্যে প্রতিদিন বিকেলে কানসাট পুকুরিয়া কলেজে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ক্রীড়া একাডেমির কোচ সেতাউর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ৩০ জন ক্ষুদে নারী ফুটবলার। 

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ক্রীড়া একাডেমির ফুটবলার শ্রী কৃষ্ণা কুমারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলতে চাই। কয়েকদিন আগে মারিয়া মান্ডা, ঋতুপর্ণা চাকমা আপুরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে দেশের মানুষের মন জয় করেছে। আমিও তাদের মতো বাবা-মা, কোচ ও ফুটবল একাডেমির মুখ উজ্জল করতে চাই। 

নারী দলের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফসানা আক্তার মিতু। সে জানায়, এলাকার অনেক মানুষ খেলতে আসা নিয়ে আজেবাজে কথা বলে। মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে কেন ফুটবল খেলি, এনিয়ে স্থানীয় মানুষজনের অনেক আপত্তি। তাদের কথা শুনে পরিবার থেকেও মাঝেমধ্যে চাপ দেয় না খেলতে। কিন্তু আমি একদিন ভালো খেলে তাদের এসব বাধা দেয়ার প্রতিবাদ জানাতে চাই। ফুটবল খেলতে গিয়ে গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি সর্মথন পেয়েছি নানা ও বাবার। 

শ্রী অন্তরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে স্কুলে যায়, বিকেলে মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে আসি। এনিয়ে রাস্তাঘাটে অনেকেই আজেবাজে কথা বলে, বিদ্রুপ করে। তবে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে এসব কথায় কান দেয় না। স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশ একদিন নারী ফুটবল বিশ্বকাপ জিতবে। আর সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে সেই অর্জনের সাক্ষী হব। 

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ক্রীড়া একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ডা. তড়িৎ কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে জানান, একজন শিশু বা কিশোরের বেড়ে উঠার জন্য খেলাধূলা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এর চরম অভাব পড়েছে। এই অভাব পূরণ করতেই আমরা গত ১ বছর আগে একাডেমির কার্যক্রম শুরু করেছি। গত ১ বছরে মেয়েরা উপজেলা, জেলা ও বিভাগীশ পর্যায়ে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। আমরা তাদের পারফর্মে দারুন খুশি ও গর্বিত। 

অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তা আরও জানান, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতার মুহুর্তগুলো আমরা ও নারী ফুটবলাররা সবাই দেখেছি। তারা এই সাফল্য দেখে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে যে জড়তা ছিল, তা কেটে গেছে। আমার তীব্র বিশ্বাস, তারা সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপার জেতার চেয়েও বড় সাফল্য পাওয়ার সক্ষমতা তাদের মধ্যে রয়েছে। 

একাডেমির দপ্তর সম্পাদক একেএম আলী হায়দার সেলিম বলেন, প্রত্যন্ত একটি গ্রামে নারী ফুটবলারদের জন্য একটি একাডেমি চালু হবে তা স্থানীয় অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। নানারকম কুসংস্কারের অযুহাতে নারীদের বাধা দিয়েছে। হাজারো বাধা পেরিয়ে একাডেমির নারীরা ফুটবলে ভালো করছে। আমরা তাদেরকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। 

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ক্রীড়া একাডেমির কোচ সেতাউর রহমান জানান, একাডেমি চালুর এক বছরের মধ্যেই ইতোমধ্যে আমরা দারুণ সফলতা পেয়েছি। বিভিন্ন টুর্ণামেন্টে মেরেরা ভালো করছে। বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা তাদের জন্য বড় অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। গ্রামের মেয়েদেরকে ফুটবলে আগ্রহ বাড়াতে নানারকম উদ্দীপনা দেয়া হচ্ছে। তারা নিজেরাও আত্নবিশ্বাসী জাতীয় দলে খেলার জন্য। 
 
জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখেছি প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের হাত ধরেই বাংলাদেশ বড় সাফল্য পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতা যাতে বজায় থাকে, সেজন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাটে যে নারী ফুটবল একাডেমি রয়েছে, তাদেরকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। তাদের সার্বিক ভালোমন্দ দিকগুলো দেখা হচ্ছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এসময় তাদেরকে নানারকম সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

২০২১ সালের ০২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ক্রীড়া একাডেমিতে ৩০ জন নারী এবং ৪০ জন ছেলে ফুটবলার নিয়মিত অনুশীলন করে‌ আসছে। ইতোমধ্যে পাইওনিয়ার লিগে ৭ জন ছেলে অংশগ্রহণ করে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। ঢাকায় চলমান অনুর্ধ-১৬ ফুটবল লিগে ২ জন ছেলে ফুটবলার উত্তরা ফুটবল ক্লাবের হয়ে অংশগ্রহণ করেছে। প্রথম বিভাগ ফুটবলে ডাক পেয়েছে ২ জন নারী ফুটবলার আর অপেক্ষমান আছে আরও ১ জন।

মো. জাহাঙ্গীর আলম/এটি