বিশ্বকাপে দলটার সর্বোচ্চ অর্জন বলতে নকআউট পর্ব। সেই সাফল্যটাও এসেছে ৩৬ বছর আগে মেক্সিকোর বিশ্বকাপে। এরপর আট বিশ্বকাপের মধ্যে আফ্রিকান দলটি সুযোগই পেয়েছে মোটে তিন বার। সেই দলটাই যে এবার সেমিফাইনালের মঞ্চে কয়জনই বা আন্দাজ করতে পেরেছিল সেটা!

এমন বিশেষ কিছুর আভাসটা বিশ্বকাপের আগেও দিতে পারেনি মরক্কো। শেষবার আফ্রিকান নেশন্স কাপে স্বাগতিক হয়েও তাদের টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছে শেষ আটে। এছাড়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচগুলোতেও খুব একটা উজ্জ্বল ছিল না তাদের পারফরম্যান্স। কিন্তু শেষটায় কী এমন ঘটল যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল তারা?

পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই একের পর এক চমক দেখিয়েছে মরক্কানরা। প্রথম ম্যাচ থেকেই তার আভাসটাও ভালোভাবেই দিয়েছে তারা। আর তাই গণমাধ্যম ও সমর্থকদের উৎসাহের কমতি ছিল না তাদের নিয়ে। অনেক গণমাধ্যমে এসেছে, ১১ ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভুত খেলোয়াড় মরক্কোর সাফল্যের রহস্য। আবার অনেকে জানিয়েছে, দৃঢ়চেতা মনোভাবের কোচই সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন দলটিকে।

ওয়ালিদ রেগরাগুই, কোচিং ক্যারিয়ারটা খুব বেশি বড় না ৪৭ বছর বয়সী এ কোচের। মোটে ৮ বছর পার করেছেন এই পেশায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, জাতীয় দলে তার অভিজ্ঞতা মাত্র ৪ মাসের। চলতি বছরের আগস্টে ওয়াহিদ হলিওডজিককে সরিয়ে দায়িত্বটা তুলে দেওয়া হয় জাতীয় দলের দায়িত্বে আনকোরা রেগরাগুইকে। বিশ্বকাপের আগে বোর্ডের এমন সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছিল সবার কাছে। সমালোচকরা উপহাস করে তার নামও দিয়ে দেন একটা, ‘অ্যাভোক্যাডো কোচ’। তখন কে জানতো এভাবে কাহিনীর নায়ক বনে যাবেন রেগরাগুই!

রেগুরাইয়ের একটা গল্প আছে। ২০০৪ সালে আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের ফাইনালে উঠেছিল মরক্কো। তবে তিউনিসিয়ার কাছে ফাইনালের সেই হার খুব বিঁধেছিল রেগুরাইয়ের। হারের পর এই রাইটব্যাক শপথই করে ফেলেন, একদিন জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নিয়ে দেশকে বিশ্বকাপে তুলবেন। বেচারা রেগরাগুই, বিশ্বকাপে তোলা তো ডালভাত। ইতিহাস গড়েই দলকে তুলে ফেললেন সেমিফাইনালে। 

ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া মরক্কোকে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বদলে দিয়েছেন রেগরাগুই। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেই জয় এনে দেন মাদাগাস্কারের সঙ্গে। এরপর থেকেই দেখা যায় অন্যরকম এক মরক্কোকে, যে মরক্কো বিশ্বকাপে চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকেই।

গোলকিপার ইয়াসিন বোনোও এই বিশ্বকাপে মরক্কোর জয়ের অন্যতম নায়ক। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে একবারও তার জালে বল জড়াতে পারেনি প্রতিপক্ষের কেউ। একবার যে গোলটা হয়েছিল সেটাও আত্মঘাতী। এই গোলরক্ষক পুরো বিশ্বকাপে যা দেখিয়েছেন তা অনেকটা বিরল। বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট স্পেনকে কোয়ার্টার ফাইনালের টাইব্রেকারে একটা বলও জালে জড়াতে দেননি। পুরোটা সময় গোলের সামনে ছিলেন দেয়াল হয়ে।

আরেকটা বড় ব্যাপার যেটা নজর কেড়েছে মরক্কোর, রক্ষণভাগে তাদের দুর্গ। স্পেন, পর্তুগাল যাদের হারিয়ে মরক্কো যাদের হারিয়ে দলটি সেমিতে এসেছে দুই দলই বিশ্বকাপে গোল করেছে মুড়ি মুড়কির মতো। অথচ মরক্কোর কাছে এসেই তাদের সব ম্যাজিক শেষ। মনে হচ্ছিল, হাকিমি-সাইসদের দুর্গ ভেদ করে গোলের নাগাল পাওয়া সম্ভব-ই না।

মরক্কো বিশ্বকাপ না জিতলেও হৃদয় জিতেছে সবার। প্রথম আরব ও আফ্রিকান দেশ  হিসেবে বিশ্বকাপে গিয়ে গোটা বিশ্বেরই সমীহ পেয়েছে দেশটি। আর মাঠে তাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব তো সবাইকে ভাবিয়েই তুলছিল, বিশ্বকাপটা না নিয়ে যায় তারা। কারণ দলটা খেলেছেই তো সেরা হয়ে। 

কাতারের টুর্নামেন্টে এখন ফাইনালের মঞ্চে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। দুদলই গ্রুপ পর্বে হেরেছে একটি ম্যাচ করে। কিন্তু মরক্কো সেমিতে ফ্রান্সের কাছে হারার আগে একটা ম্যাচেও হারেনি, ড্র করেছে অবশ্য এক ম্যাচে। অথচ বিশ্বকাপের আগে গ্রুপ পর্ব যে পেরোতে পারবে মরক্কো, সেটাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কেউ। ভাবনাটা অবশ্য বেশ স্বাভাবিকও।

এফ গ্রুপে মরক্কোর প্রতিপক্ষ ছিল ক্রোয়েশিয়া ও বেলজিয়াম। অনুমেয় ছিল, এই দুই দলই উঠবে শেষ ষোলতে। কারণ গত বিশ্বকাপেই তো ফাইনাল, সেমিফাইনাল খেলেছিল তারা। আর এবারের বিশ্বকাপেও দল ছিল সেরকমই। কিন্তু ১৪ দিনের গ্রুপ পর্ব লড়াই শেষে সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ ষোলতে মরক্কো, বাদ সোনালী যুগের বেলজিয়াম।

তখনও অনেকের মুখে ফ্লুক, ফ্লুক কথাটা বেশ চলছিল। কিন্তু সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে নকআউটে স্পেনকেও হারিয়ে দেয় মরক্কানরা। উজ্জীবিত ফুটবলের মরক্কো কোয়ার্টারে এসেছে এই অনেক কিছু। আবার সেমিফাইনালও খেলবে নাকি। ভাবনাটা এমনই ছিল অধিকাংশের। প্রতিপক্ষ যখন আগের ম্যাচে ৬ গোল করা পর্তুগাল তখন সেটাকে স্বাভাবিকই বলা যায়। তবে এবারও অপ্রতিরোধ্য হাকিমিরা। রোনালদোদের কাঁদিয়ে সেমিতে রেগরাগুইরের শিষ্যরা। 

সেমির লড়াইয়ে এসে শেষমেষ থামতে হল মরক্কোকে। শেষ হল আফ্রিকান রূপকথা। আল বায়াত স্টেডিয়ামের হাজার হাজার মরক্কান দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়ে ফাইনালে উঠে যায় ফ্রান্স। কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপকথার গল্প লেখা হাকিমি-ইউসেফরা। তবে একটুও হেরেছে কি মরক্কো?

গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের যতোটা চাপে ফেলেছিল মরক্কো, এমবাপে-জিরুডদের এতোটা চাপে ফেলতে পারেনি কেউই। এতোটা উজ্জীবিত ফুটবল খেলেও কি কেউ হারে! মরক্কো হৃদয় জিতেছে। অনাবিল আনন্দ দিয়ে মন জিতেছে সবার। মাঠ ও মাঠের বাইরে তাদের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও মায়ের সঙ্গে সহজ সুন্দর উদযাপন মন কেড়েছে সবার। তাই কেঁদেকেটে বিদায় নিলেও আফ্রিকান দলটির এই রূপকথার গল্প অনেক অনেক দিন মনে থাকবে ফুটবল ভক্তদের।

এটি