হাজার হাজার কাঁচের টুকরোয় লুকিয়ে ছিল মহামূল্যবান এই হীরা! তাকে খুঁজে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু রোজারিও সেন্তা ফে’র ছোট্ট এক মাঠে ধুলোবালির মধ্যে খেলতে থাকা ছোট্ট সেই হীরের টুকরোকে ঠিকই চিনে নিয়েছিলেন বার্সেলোনার এক স্কাউট। ধুলো মাখা পোশাকের ছোট্ট আদুরে চেহারার শিশুটির ফুটবল নিয়ে কারিকুরি মুগ্ধ করে দেয় তাকে। ব্যস, ভাগ্য খুলে যায় হোর্হে হোসারিওর। যিনি সেই শিশুটির বাবা!

ছেলে বল নিয়ে ড্রিবলিং-ডজের খেলায় মেতে ওঠে আর বাবা তা দেখে মুগ্ধ হন। কেউ একজন তাকে ভর্তি করিয়ে দিল রোজারিওরই ক্লাব নিউয়েল ওল্ড বয়েজে। কিন্তু এরপরই হঠাৎ আসে সেই দুঃসংবাদ- ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম’ রোগে আক্রান্ত শিশুটি। সেই রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই দরিদ্র বাবার। 

হঠাৎই আচমকা এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু! আদরের সন্তানটির গায়ের রং ফিকে হয়ে আসতে থাকে। চিন্তায় পড়ে যান বাবা। পরে জানা যায়, হরমোনজনিত এক সমস্যায় ভুগছে সন্তান। এটাই লিওনেল মেসির শিশুবেলার গল্প, বয়স তখন ১৩। এই রোগ থেকে সেরে উঠতে তার চিকিৎসায় প্রতিমাসে প্রয়োজন ৯০০ ডলার। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে বাবার। যাকে নিয়ে দারিদ্র্য কাটানোর স্বপ্ন দেখছিলেন সেই অবলম্বনটিই কি না দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে! ঠিক তখনই হোসারিওর কাছে স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসেন সেই ফুটবল স্কাউট।

সেই ফুটবল স্কাউটদের হাত ধরেই বার্সেলোনায় পা রাখে ১৩ বছরের সেই শিশুটি। পুঁচকে ওই ফুটবলারটির বল নিয়ে ক্যারিশমা দেখে তো মুগ্ধ সবাই। চটজলদি তাকে দলে নিতে টিস্যু পেপারেই চুক্তি হয়ে যায়! এরপর বার্সার একাডেমিতে হয়েছে ছোট্ট সেই শিশুটির পরিচর্যা সঙ্গে চলেছে ব্যয়বহুল চিকিৎসা।

কার্লোস রেক্সাস, যিনি বার্সেলোনার তখনকার ক্রীড়া পরিচালক। ছোট্ট লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনায় জায়গা করে দেন তিনিই। হাঁফছেড়ে বাঁচেন হোর্হে হোসারিও মেসি। যিনি ফ্যাক্টরিতে ছোটখাটো চাকরি করেন। মা পরিচ্ছন্নতা কর্মী। ইতালি থেকে তারা পাড়ি জমিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায়। পরিবারের চতুর্থ ছেলের হাত ধরেই যে একদিন এই আর্জেন্টাইন দম্পতির জীবনটা পাল্টে যাবে কে জানতো?

এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা। ন্যু ক্যাম্পের ক্লাবটিতেই প্রতিভার যত্ন-আত্তি হয়েছে মেসির। সময়ের পথ ধরে তার অর্জনগুলোও জানা হয়ে গেছে ভক্তদের। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মেসি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০ অ্যাথলিটের একজন। 

সাতবারের ফিফার বর্ষসেরাকে কি এই খ্যাতি আর অর্থ বদলে দিয়েছে? মোটেও না। এখনও সেই আগের মেসিই আছেন তিনি। পা মাটিতেই আছে ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন জন্ম নেওয়া এ ক্ষুদে ফুটবল জাদুকরের।

সংসার পেতেছেন শৈশবের প্রেমিকা রোজারিওর মেয়ে আন্তেনেল্লা রোকুজ্জোর সঙ্গে। দু'জন ছিলেন পারিবারিক বন্ধু। মেসি রোজারিও ছেড়ে বার্সেলোনায় চলে গেলেও যোগাযোগটা ঠিকই ছিল। ছুটি পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন বার্সা তারকা। এভাবেই ভালোবাসা শুরু। ২০০৮ সালের ক্রিসমাসের ছুটিতে রোজারিওতে বেড়াতে গেলেন মেসি। বার্সেলোনা থেকে বিমানে ওঠার আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন-যা হওয়ার হোক, এবার মনের কথাটা বলেই আসবেন। আর এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন আন্তেনেল্লা। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তাদের প্রেমের গল্প।

মেসির মতোই সাদামাটা আন্তেনেল্লা। অন্যসব সেলিব্রেটির সঙ্গীদের মতো ‘পেজ থ্রি’ পার্টির ধার ধারেন না। এরই মধ্যে তাদের সংসারে এসেছে তিন সন্তান। 

মাঠের জানা গল্পটাতেও চোখ বুলিয়ে নেই চলুন-২০০৩ সালের পোর্তোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে বার্সেলোনা সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক। তখন বয়স ১৬ বছর ১৪৫ দিন। তারপর দু পায়ের ম্যাজিকে শুধুই লিখেছেন এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ক্ষুদে জাদুকর থেকে সাত ছয়বারের বর্ষসেরা। ক্লাব ফুটবলে সব ট্রফিই মিলেছে। ১০টি লা লিগা, চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, তিনটি ফিফা ক্লাব কাপ ট্রফি! আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে রানার্স আপ, কোপা আমেরিকার শিরোপা। 

জাতীয় দলের হয়ে আসল কাজটাই তো করা হচ্ছিল না। ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষেক। হাঙ্গেরির বিপক্ষে সেই অভিষেক ম্যাচটিকে অবশ্য মেসি নিজেও আর স্বীকৃতি দেন না। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ৬৩ মিনিটে মাঠে নামার ২ মিনিট পরই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। সেই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মেসির পুরোদস্তুর অভিষেক হয় প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে। তারপর ক্যারিয়ারে শেষ বেলাতে এসে হাতে ধরা দিয়েছে কোপা। তবে তাতেও কী স্বস্তি মিলছিল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির মেসির? 

৩৫ পেরিয়ে এসে লড়েছেন প্রাণপন। ২০১৪ সালে এমন কী তার সতীর্থরাও ভাবতো সব করে দেবে মেসি। এবার একেবারেই আলাদা দৃশ্যপট। নিজে সত্যিকারের নেতার মতো খেলিয়েছেন পুরো দলটাকে। তার পথ ধরেই তো মিলে গেল স্বপ্নের শিরোপা। বিশ্বকাপ ট্রফি। ম্যাচে নিজে করলেন দুটি গোল। করালেন আরেকটি। এরপর টাইব্রেকারের রোমাঞ্চে লুইসাল স্টেডিয়ামে রাতের কৃত্রিম আলোয় উড়ল আর্জেন্টিনার জয়ের ফানুস। ৪-২ গোলে জয়! ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ। ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর মেসি!

ফুটবল তার আভিজাত্য ধরে রাখার স্বার্থেই কাজটা করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ! গ্রেট আর সর্বকালের সেরাদের ওই সোনার ট্রফি থেকে বঞ্চিত করে না ‘ফুটবল ইশ্বর!’ কিংবদন্তিদের প্রায় সবাই মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি সঙ্গী করেই বিদায় বলেছেন। পেলে জিতেছিলেন, একবার নয়, তিন তিন বার! 

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে উঠেছে গারিঞ্চা, জর্জিনহো, রিভেলিনো, ফ্রাঞ্চ বেকেনবাওয়ার, ববি চার্লটন, গার্ড মুলারের। বঞ্চিত হননি আর্জেন্টাইন ফুটবল ইশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। বিশ্বকাপ ট্রফি মাথার ওপরে তুলে দাড়িয়েছেন রোমারিও, রোনালদো আর জিনেদিন জিদানও।

এবার চক্র পূরণ হলো। লিওনেল মেসির হাতেও উঠল ৬.১৭৫ কিলোগ্রামসের ১৮ ক্যারেট সোনায় তৈরি ট্রফিটি। কাছে গিয়েও আক্ষেপ, হতাশায় চুপসে যাওয়া, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াবেন সেই নিস্তরঙ্গ দৃশ্যেরও সমাপ্তি। দেবশিশু আরও একবার যদিও কাঁদলেন। হাসিমুখে সুখের কান্না! 

আহা, জীবনের শেষ ম্যাচটার পান্ডুলিপি নিজেই হয়তো লিখেছেন তিনি। না, হলে রোজারিও সেন্তা ফে’র গলির পথে যে শিশু হারিয়ে যেতে পারতেন অবহেলায়; তিনি কী করে আজ বনে গেলেন বাজিকর, ফুটবল ইশ্বর! লুসাইলে আলো ঝলমলে রাতে রোববার ফুটবলটাও সমৃদ্ধ হলো মেসির বাঁ পায়ের মুগ্ধতায়!

অভিনন্দন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি!

এটি