‘প্রফেসর’ ভলান্টিয়ার
‘প্রফেসর কিপ মি ইন ইউর প্রেয়ার’। প্রফেসর শব্দটি শুনে অনেকে ঘাড় ঘুরালেন। ব্রাজিল তো বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে দশ দিনের বেশি। কোচ তিতে আবার হঠাৎ কাতার ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি)! না তিতে আসেননি। বিশ্বকাপ শেষে ভলান্টিয়াররা বিদায় নিচ্ছেন হুবার্ট বিহলার কাছ থেকে।
হুবার্ট ফিফার বড় কোনো কর্মকর্তা নন, অন্য ভলান্টিয়ারদের মতো তিনিও একজন ভলান্টিয়ার। বয়স, একাগ্রতা ও অভিজ্ঞতা তাঁকে সবার চেয়ে আলাদা করেছে। এজন্যই অন্য ভলান্টিয়াররা তাকে ‘প্রফেসর’, ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করেন।
বিজ্ঞাপন
জার্মানির ভলান্টিয়ার হুবার্টের বয়স ৭৬। কিছুদিন পরেই ৭৭ এ পা রাখবেন। মেইন প্রেস সেন্টারে বিদায় লগ্নে দাড়িয়ে হুবার্ট ভলান্টিয়ারে আসার গল্প শোনালেন, ‘২০০৫ সালে শিক্ষক হিসেবে আমি অবসরে যাই। বয়স তখন ছিল ৫৯। আমি শিক্ষক হলেও সারা জীবন খেলার সঙ্গেই ছিলাম। আমার এলাকার ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছি ৩০ বছর। ফুটবলও খেলেছি অনেক দিন। অবসরের পর চিন্তা করলাম বাকি জীবন খেলার সঙ্গেই কাটাব। ২০০৬ সালে ছিল জার্মানিতে বিশ্বকাপ। ভলান্টিয়ার আবেদন করি এবং কাজটি পেয়ে যাই।’
জার্মানি বিশ্বকাপের পর হুবার্টকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ছিল তার উপস্থিতি। ২০০৬-২২ পর্যন্ত তিনি ৫০ টির বেশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি ফিফা বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক। মহিলা ফুটবল বিশ্বকাপও রয়েছে একটি। ফুটবলের বাইরে হকি, জিমন্যাস্টিকস, অ্যাথলেটিকস বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপেও ভলান্টিয়ারিং অভিজ্ঞতা রয়েছে তার ঝুলিতে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ছিলেন বেশ কয়েকবার। ক্রীড়া বিশ্বে তিনিই এখন সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবক।
অর্ধ শতাধিক প্রতিযোগিতার ভলান্টিয়ারিং করলেও তার হৃদয়ে নিজ দেশের বিশ্বকাপের স্মৃতি বড় করে আকা, প্রথম সব কিছু বিশেষ। ‘২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপই আমার স্মরণীয়। ফুটবল বিশ্বকাপে ভলান্টিয়ারিং বেশি ভালো লাগে। অলিম্পিকের সময় অ্যাথলেটিক্সে কাজ করি।’
ভলান্টিয়ার হিসেবেও তার রয়েছে বিশেষত্ব। তিনি ফটো সাংবাদিকদের ভলান্টিয়ার হিসেবেই কাজ করছেন এক যুগের বেশি সময়। এই দিকে কাজ করার কারণটিও বললেন, ‘আমার শিক্ষকতা জীবনে ম্যাগাজিন বের করেছি। সেখানে আমার ছবি বেশি প্রকাশিত হতো। সেখান থেকে ছবি তোলার নেশা। তাই ভলান্টিয়ার হিসেবে ফটোগ্রাফারদের সাথেই কাজ করি।’
ভলান্টিয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশেষ এক উচ্চতায়। এখন তিনি ভলান্টিয়ারদের ভলান্টিয়ার। বড় টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তাকে অনেক সময় জার্মানি থেকে উড়িয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুষ্ঠানেও তাকে বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখতে হয়। অনেকের কাছে ভলান্টিয়ারিং ‘নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর মতো বিষয়’ হলেও তার কাছে ভিন্ন, ‘ ভলান্টিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আমি বিশ্বকে দেখেছি। বিশেষ করে অলিম্পিক ও ফুটবল বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্বের সকল দেশের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। এর মাধ্যমে জীবনের অনেক শিক্ষাই অর্জন করেছি। কেউ যদি জীবন শিখতে ও জানতে চায় তার অবশ্যই ভলান্টিয়ারিংয়ে আসা উচিত।’
ভলান্টিয়ারিং অনেক পরিশ্রমের কাজ। ৭৬ বছর বয়সে দেশের বাইরে সারা দিন রাত খাটুনি পরিবারের অনেকের কাছেই উদ্বেগজনক। হুবার্টের পরিবার এটি মেনে নিয়েছে, ‘আমার স্ত্রী গত বছর মারা গেছেন। সন্তানরা জানেন ভলান্টিয়ারিং করলে তাদের বাবা ভালো থাকবে। আমি ভলান্টিয়ারিংয়ের সময় আসলেই উপভোগ করি’, বেশ তৃপ্তি নিয়ে বলছিলেন এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে সিনিয়র ভলান্টিয়ার।
এজেড/এনইআর