প্রধান ফটক সিলগালা, তার সঙ্গে আশেপাশের পরিবেশ দেখে রীতিমতো পেড়োবাড়ি ঠাহর করে বসাটাও অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের বর্তমান অবস্থা এমনই/ছবি: ঢাকাপোস্ট

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে মতিঝিল এলাকায় সাজ সাজ রব। ব্যাংকপল্লী সেজেছে অপরূপ রূপে। মতিঝিলের মুল রাস্তার উল্টো দিকেই ক্লাব পাড়া। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবও এখানে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে এই ক্লাব সাজার কথা সবচেয়ে বর্ণিল রুপে। উল্টো সেই ওয়ান্ডারার্স যেন ধুকে ধুকে কাঁদছে। ক্লাবের দেয়ালে কান পাতলেই শোনা যায় সেই আর্তনাদ। মঙ্গলবার বিকেলে ক্লাব প্রাঙ্গণে মুল ফটকে ঝুলানো তালা যেন ক্লাবের ৮৪ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। 

১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ফুটবলে দাপট দেখিয়ে গেছে । টানা চারবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ওয়ান্ডারার্স। যে কৃতিত্ব স্বাধীনতার আগে ও পরে কোনো ক্লাবের নেই। স্বাধীনতার পরেও ছিল ক্ষয়িষ্ণু যৌবন। নব্বইয়ের দশক থেকে সাংগঠনিক ব্যর্থতা সহ নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ক্লাবটি ক্রীড়াঙ্গনে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল। পিছিয়ে পড়লেও ফুটবল, হকি, বক্সিং,কাবাডিতে ধুকে ধুকে ওয়ান্ডারার্সের পতাকা উড়ছিল। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো ঝড়ে একেবারে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায় ক্লাবটি। অবৈধ ক্যাসিনো হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ক্লাব সিলগালা করে দেয়। প্রায় দেড় বছর হতে চলছে এই অচল অবস্থার।

সিলগালা অবস্থার মধ্যেই চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ফুটবলে খেলছে ওয়ান্ডারার্স। ফুটবলারদের কয়েকজন থাকেন পাশের ক্লাব আজাদ স্পোর্টিংয়ে। কয়েকজন আবার হোটেলে, কেউ আবার কারো বাসায়। এভাবে যাযাবর হয়ে লিগ খেলছে ওয়ান্ডারার্স। আবাসনের মতো খাবারের অবস্থাও করুণ। ক্লাবের নেই আয়, ক্যাসিনো কান্ডের পর কেউ অনুদানও দেয় না তেমন একটা। কারো কাছ থেকে চাল, কারো কাছে এক বস্তা ডাল এভাবে চেয়ে চিলতে করে ক্লাব চালাচ্ছেন কর্মকর্তারা। 

কোচ কামাল বাবু নিজে পারিশ্রমিক নেয়ার বদলে উল্টো ১৮ হাজার টাকা দিয়েছেন ফুটবলারদের পারিশ্রমিক পরিশোধের জন্য। এত কষ্ট করে লিগ খেললেও ফুটবল ফেডারেশন এখনো অংশগ্রহণ ফি দেয়নি। ক্লাবের এই দুরবস্থায় ফুটবলের সাথে সংযুক্ত একটি বড় গ্রুপ ৩ লাখ টাকার চেক দেয়। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন হওয়ায় সেই চেক ভাঙাতেও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক।

ক্যাসিনো অভিযানের পর সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা আবু কাউসার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। সাধারণ সম্পাদক জয় গোপাল সরকার জেল হাজতে গেছেন। সহ-সভাপতি কাজী লিটনকে সভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক বিপুল ঘোষ শঙ্করকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেছেন কার্য নির্বাহী কমিটির সবাই মিলে। তারা এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে লড়ছেন প্রাণপণ।

কোনো মতে ফুটবল লিগ শেষ করতে পারলে আমরা হাফ ছাড়তে পারব। ক্লাবে কেউ যেতে পারি না। মিটিং হয় কারো বাসায় না হয় অফিস বা হোটেলে। এভাবে টেনে যাওয়া কঠিন।

কাজী লিটন, সভাপতি, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স

অবৈধ ক্যাসিনোর জের টানতে হচ্ছে এখনো। ক্লাবের সভাপতি কাজী লিটনের অসহায় আকুতি , ‘দোষ করেছে ব্যক্তি, ব্যক্তির সাজা হোক। প্রতিষ্ঠানের তো দোষ নেই। প্রতিষ্ঠানকে আর কত সাজা পেতে হবে।’

সাধারণ সম্পাদক শঙ্করের শঙ্কা, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। সেই ঐতিহাসিক ছবি ক্লাবে আছে। ক্যাসিনো অভিযানের পর সেই ছবি সহ বঙ্গবন্ধুর আরো কিছু স্মৃতি কোন অবস্থায় আছে আমরা বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে অনেক জায়গায় অনেক অনুষ্ঠান হলেও বঙ্গবন্ধুর নিজের ক্লাবে আমরা কিছু করতে পারছি না এটা খুবই পীড়া দিচ্ছে।’ 

বঙ্গবন্ধু ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। গ্যালারিতে বসে ওয়ান্ডারার্সের খেলা দেখেছেন। ওয়ান্ডরার্সের সাথে কয়েকটি সফরও করেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শহীদ শেখ কামালের ক্লাব আবাহনী। আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পেয়েছেন। আবাহনী তার ছেলের ক্লাব হলেও ওয়ান্ডারার্সের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা অনেকবার চোখে পড়েছে হারুনের, ‘স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু ওয়ান্ডারার্সের সমর্থক। স্বাধীনতার পর কামাল আবাহনী করলেও বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমার ক্লাব ওয়ান্ডারার্স।’ 

ক্রীড়াঙ্গনে এই মুহূর্তে জীবিত ও সক্রিয় কর্মকর্তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ রোইং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হাজী খোরশেদ। তিনিও বঙ্গবন্ধুর ওয়ান্ডারার্স প্রেম দেখেছেন, ‘ষাট দশকে আমি লগি বৈঠার আন্দোলন করতাম। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ওয়ান্ডারার্স খেলা দেখতে নিয়ে যেতেন অনেক সময়। মাঠে যেতে না পারলেও খোঁজ রাখতেন।’

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সরকারের কত আয়োজন। খোদ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরই কত কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু ক্লাব ওয়ান্ডারার্সকে সচল ও ক্রীড়াঙ্গনে আগের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ।

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে ক্লাব সচল করার অনুরোধ জানিয়েছেন, ‘ক্লাবগুলো নিবন্ধিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর ক্যাসিনো কান্ডের জন্য বন্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনত ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এখানে কিছু করার এখতিয়ার নেই। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছি ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে ক্লাবগুলো খুলে দেয়ার জন্য।’

হকি ফেডারেশনের সভাপতি বিমান বাহিনীর প্রধান প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্রীড়াঙ্গনের এই সংকট তুলে ধরেছেন। হয়ত সামনে কোনো একদিন আবার সচল হবে ক্লাব। খেলা, আড্ডায় মুখরিত হবে ওয়ান্ডারার্স প্রাঙ্গন। প্রতিদিনই চলবে বঙ্গবন্ধু ও ওয়ান্ডারার্স নিয়ে আলোচনা। নিজের জন্মশতবার্ষিকীর মতো ২০৩৭ সালে ওয়ান্ডারার্সের শতবর্ষে এমন কোনো আয়োজন হলে ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক বঙ্গবন্ধু ওপার থেকেও আনন্দিত হবেন নিশ্চয়ই!

এজেড/এনইউ