গোলের খেলা ফুটবল, সালাউদ্দিন না এনায়েত কে সেরা এ নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে চিরকালীন আলোচনা। ফরোয়ার্ড পজিশনের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্ক থাকলেও গোলপোস্টের নিচে শহিদুর রহমান চৌধুরী সান্টুকেই অনেকে এগিয়ে রাখেন যোজন দূরত্বে। রংপুর থেকে ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় এসে দেশের ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের একজন হয়েছেন। দীর্ঘদিন আমেরিকার ডালাসে প্রবাস জীবনযাপন করছেন। গত সপ্তাহে বাংলাদেশে এসেছিলেন। গেল বুধবার আমেরিকার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। এর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে সব বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন।  

এক সপ্তাহের সফরে এসেছেন। ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও দুই দিন ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গেলেন। 

সান্টু: নারীদের ফুটবল ম্যাচ দেখার ইচ্ছে ছিল। ঐ দিনই আবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। সিরাজ (এনায়েত হোসেন সিরাজ সাবেক ক্রিকেটার ও বোর্ড পরিচালক ) বেশ করে ধরল। তাই ক্রিকেটেই গেলাম। আমি ফুটবলার হলেও ক্রিকেট আমার গভীর প্রেম। 

ক্রিকেট খেলতেই আপনি ষাটের দশকে ঢাকা এসেছিলেন। সেখান থেকে ফুটবলে গোলরক্ষক এবং দেশের সর্বকালের সেরাদের একজন ফুটবলার। 

সান্টু:  আমার বড় ভাই আজিজুর রহমান চৌধুরি ক্রিকেটার ছিলেন। তাকে অনুসরণ করেই রংপুরে ক্রিকেট শুরু করি। ছোটবেলায় সব খেলাই খেলেছি। আসলেই আমি ক্রিকেট খেলতেই এসেছিলাম ঢাকায় এবং ক্রিকেটারই হতে চেয়েছিলাম। ঢাকায় এসে জামান ভাইদের (বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক) দল (ন্যাশনাল স্পোর্টিং) এর বিরুদ্ধে সাত উইকেট নিয়েছিলাম। 

ক্রিকেটার থেকে ফুটবলে গোলরক্ষক হলেন কিভাবে ?

সান্টু: ক্রিকেট খেলতে এসে সেবার একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাই। তখন সেই দলে গোলরক্ষক সংকট ছিল। আজাদ স্পোর্টিংয়ের রণজিৎ দা আমাকে গোলরক্ষক পজিশনে দাঁড়াতে বললেন। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখান থেকেই গোলরক্ষকের যাত্রা শুরু। এর কিছুদিন পরেই রংপুর জেলা দলে ডাক পাই। সেখান থেকে রাজশাহী বিভাগেও ( তখন রংপুর রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ছিল)। রাজশাহী বিভাগে তখন শামসু ভাই (প্রয়াত ফুটবলার ও জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটের বাবা) অনেক বড় তারকা। তাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাই। বিভাগের হয়ে আমি ফাইনাল ম্যাচ খেলি এবং সেরা খেলোয়াড় হই। আমার খেলা দেখে ভিক্টোরিয়া ও ওয়ান্ডারার্স দলে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। শেষ পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্সেই খেলা শুরু হয়। স্বাধীনতার আগে ওয়ান্ডারার্সের অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল। 

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে রণজিৎ দাশ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আপনাকে সেরা গোলরক্ষক বলা হয়। আপনার দৃষ্টিতে আপনারা দুই জন কেমন?

সান্টু: সত্যিকার অর্থে রণজিৎ দার জন্য আমি ফুটবলে এবং গোলরক্ষক। তিনি অনেক উঁচু মাপের গোলরক্ষক। কিছুটা কম উচ্চতা নিয়েও দারুণ কিপিং করেছেন। আমি নিজেকে সাধারণ একজন মনে করি। অগ্রজ মিন্টু ভাই ও অনুজ অনেকে ভালো কিপার ছিল। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে টানা এক দশকই গোলরক্ষক পজিশন আপনার জন্য নির্দিষ্ট ছিল জাতীয় দলে। 

সান্টু: রাজশাহী বিভাগে গোলরক্ষক হিসেবে খেলার সুযোগ পেলাম। এরপর দেড় যুগ আমার আর জায়গা ছাড়তে হয়নি কখনো। 

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দলে খেলা ফুটবলার মাত্র তিন জন (জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ও শহিদুর রহমান চৌধুরি শান্টু )। পিন্টু ও প্রতাপ বাংলাদেশ দলে বেশিদিন খেলতে পারেনি। আপনি দুই দলেই মোটামুটি দীর্ঘদিন ছিলেন। 

সান্টু: দারুণ তো বিষয়টি। এভাবে কখনো ভাবিনি। হাফিজ ভাই, টিপু ভাইরা পাকিস্তান দলে খেললেও বাংলাদেশে খেলতে পারেননি। সালাউদ্দিন এনায়েতরা বাংলাদেশে খেললেও পাকিস্তান দলে ছিল না। আমি পাকিস্তান দলে বছর চারেক। বাংলাদেশে এক দশক খেলতে পেরেছি। 

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যখন গঠন হয়। তখন আপনি অনেকটাই সিনিয়র ফুটবলার। সর্বকনিষ্ট সদস্য ছিলেন সালাউদ্দিন। আপনি স্বাধীন বাংলা ছিলেন না কেন?

সান্টু: আসলে আমারও স্বাধীন বাংলা দলে যাওয়ার কথা ছিল। সালাউদ্দিন যেদিন যায় সেদিন আমার বাসায় ডাকতে এসে পায়নি। দল চলে যাওয়ার পরেও দুই তিন বার আমার ডাক এসেছিল। তখন পারিবারিক ও সামগ্রিক কারণে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমি ঢাকায় বোনের বাসায় থাকতাম। বোনের বাচ্চা ছোট ছিল। এটা একটা কারণ আরেকটি বিষয় আজিমপুরে আমি কলোনীতে তখন অনুশীলন করাতাম। পাকিস্তান আর্মিরা দেখত এখানে বাচ্চারা অনুশীলন করে এজন্য তেমন নজর দেয়নি। আমি না থাকলে অনুশীলন বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে আর্মিরা সমস্যা করতে পারতো। না যাওয়ার পেছনে এটাও বড় কারণ। আজিমপুরে ইয়ং পেগাসাস গঠনের পেছনেও আমার ভূমিকা ছিল। 

সত্তর দশকের প্রায় পুরো সময় জুড়েই আপনি দেশের সেরা গোলরক্ষক। ইস্ট এন্ড, ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, ব্রাদার্সে খেললেও আবাহনীতে কখনো খেলা হয়নি কেন ?

সান্টু: কয়েকবারই আমার আবাহনীতে খেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একবার তো আমাকে খেলতেই হতো এমন অবস্থা। আবাহনী অনেকটা জাতীয় দলই হয়ে যাচ্ছে। তখন ইস্ট এন্ড বলল তাদের দলে খেলতে কথা দিয়েছিলাম এবং ইস্ট এন্ডেই খেলেছি।

 

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঘটনাবহুল বছর ১৯৭৮। সেই বছর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করে। ফুটবল দলের অধিনায়ক প্রথমে আবাহনীর মনোয়ার হোসেন নান্নুকে করা হয়। পরবর্তীতে আপনাকে অধিনায়ক করায় আবাহনীর সাত ফুটবলার যায়নি এশিয়াডে।

সান্টু: অধিনায়ক ফেডারেশনই ঘোষণা করে। আমার যে দল ছিল সেই দল নিয়েই আমি গিয়েছি এশিয়াডে। তারা থাকলে আরো ভালো হতো। দেশের স্বার্থ আগে বিবেচনা করা দরকার। 

আপনার বাড়ি এবং সেই সময় ক্ষমতাসীন এরশাদের বাড়িও রংপুর। আপনার অধিনায়কত্ব পাওয়ার পেছনে নাকি এটাও একটা কারণ এমন জনশ্রুতি আছে।

সান্টু: এটা একদমই নয়। আমার সঙ্গে তার তেমন সখ্যতা ছিল না বরং কিছু অংশে দূরত্বও ছিল। আমি কোনো সুবিধা চাইওনি কখনো। বরং আমি প্রবাসী হয়ে যাওয়ায় তার কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন একজন।

গোলপোস্টের নিচে কোন স্ট্রাইকারকে আপনার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে?

সান্টু: পাকিস্তান আমলের কথা আপনিই বলছিলেন। আসলেই সেই তিন চার বছর ইরান, তুরস্কের অনেক স্ট্রাইকারকে মোকাবিলা করেছি। এরপর থেকেই মূলত ভয় কেটে গেছে। বাংলাদেশে কাউকে আমার তেমন ভয় লাগেনি। এর মধ্যেও কয়েকজনের বিশেষ স্কিল ছিল। সালাউদ্দিনের পজিশন সেন্স, এনায়েত ও নওশেরের শুটিং দক্ষতা বেশ ছিল। অনেক কিপারের ১.১ ভয় লাগলেও আমি ১.১ বেশ মজা পেতাম।

ক্রিকেট আমার প্রথম পছন্দ। ফুটবল ও ক্রিকেট উভয় লিগ এক সঙ্গে খেলেছি। মোহামেডানের হয়ে অনেক উইকেট আছে আমার। ক্রিকেট জাতীয় দলের ক্যাম্পেও ছিলাম। প্রথম আইসিসি ট্রফিতে (১৯৭৭ সালে) আমার দলে থাকার কথা। পরে শুনি দলে নাই। ফুটবলে বিদেশি কোচরা আসার পর একটা খেলায় মনোযোগ দিতে বললেন। এরপর ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যেতে হয়।

 

গোলরক্ষক হিসেবে আপনার আদর্শ?

সান্টু: অবশ্যই লেভ ইয়াসিন। তাকেই অনুসরণ করতাম। তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। 

কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে আপনার কখনো এক ক্লাবে খেলা হয়নি। এরপরও আপনাদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব।

সান্টু: আমাদের সময় সব ক্লাবের ফুটবলারদের মধ্যেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কোনো দূরত্ব ছিল না। জাতীয় দলে আমার রুমমেট ছিল সালাউদ্দিন। ১৯৭৫ সালে মারদেকায় সালাউদ্দিন অধিনায়ক ছিল। আমি ওর রুমেই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ আমরা এক সঙ্গেই শুনেছিলাম। সালাউদ্দিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের আরেকটি মাধ্যম ক্রিকেট। দুই জনই ক্রিকেট খেলতাম। বাদশা, তান্না, আশরাফুল আরো অনেকেই আমাদের কমন ফ্রেন্ড। 

জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহর কথা বলছিলেন। সে তো জাতীয় ফুটবল ও ক্রিকেট উভয় দলে খেলেছে। আপনি ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় এলেন জাতীয় ফুটবল দলে খেললেও ক্রিকেটে খেলা হয়নি। এটা আপনাকে কষ্ট দেয় না। 

সান্টু: আসলে সত্যিকার অর্থে ক্রিকেট আমার প্রথম পছন্দ। ফুটবল ও ক্রিকেট উভয় লিগ এক সঙ্গে খেলেছি। মোহামেডানের হয়ে অনেক উইকেট আছে আমার। ক্রিকেট জাতীয় দলের ক্যাম্পেও ছিলাম। প্রথম আইসিসি ট্রফিতে (১৯৭৭ সালে) আমার দলে থাকার কথা। পরে শুনি দলে নাই। ফুটবলে বিদেশি কোচরা আসার পর একটা খেলায় মনোযোগ দিতে বললেন। এরপর ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যেতে হয়।

দেশের বর্তমান ফুটবল ও ক্রিকেটের অবস্থা আপনার দৃষ্টিতে কেমন? 

সান্টু: এই বার ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়ে নান্নু ( প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন), আকরাম, জালাল সবাইকে বলেছি আমাদের ক্রিকেটের অবস্থান আরো উপরে থাকা উচিত ছিল। ক্রিকেটে মাঝে মধ্যে সাফল্য আসছে কিন্তু ফুটবলে জাতীয় দলের অবস্থা আগের পর্যায়েই।

২০০৯ সালে আপনি জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। আপনার কোচিংয়ে বাংলাদেশ সাফে সেমিফাইনাল খেলেছে সর্বশেষ। এরপর আর গ্রুপ পার হতে পারেনি। 

সান্টু: সেটাই তো বললাম সেই পর্যায়েই রয়েছে। ফুটবলে একটি জুনিয়র দল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা উচিত। ২০০৪ সালের দিকে হেলাল ভাই (সাবেক সাধারণ সম্পাদক) আমাকে তৃণমূলে কাজ করার জন্য এনেছিলেন। মিশু, মামুনুলসহ একটি ব্যাচ তৈরি করেছিলাম। সেই ব্যাচটিই বাংলাদেশের ফুটবলে এক যুগ খেলেছে। এরপর আর তেমন কাজ হয়নি।

২০০৮ সালে আাপনার বন্ধু কাজী সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হন। এর কিছু দিন পরেই আপনাকে ট্যাকনিক্যাল ডাইরেক্টর করে আনেন। যদিও আপনি বেশি দিন থাকেন তারপরও আপনার বন্ধু এখনো সভাপতি রয়েছে তাকে ফুটবল উন্নয়নের পরামর্শ দেন।

সান্টু: ২০০৮ সালে সালাউদ্দিন সভাপতি হওয়ার পর আমাকে ট্যাকনিক্যাল ডাইরেক্টর করল। আমি কিছু প্রস্তাব ও পরিকল্পনা দিয়েছিলাম। সেগুলো বোর্ডে গৃহীত হয়নি। সালাউদ্দিন ছাড়াও বাফুফেতে অনেক ফুটবলারই ছিল। পরিকল্পনা গৃহীত না হলে আর কাজের সুযোগ কোথায় এবং সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আগেই আমি পুনরায় আমেরিকায় চলে যাই।

আপনি ট্যাকনিক্যাল ডাইরেক্টর থাকাবস্থায় নারী ফুটবল নিয়েও কাজ করেছিলেন। আজ এই নারী ফুটবল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। 

সান্টু: নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করার জন্য বাচ্চু ভাই (প্রয়াত বাফুফের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান) আমাকে অনুরোধ করে। রেহানা পারভীন কয়েকজন আনসারের ফুটবলার এনে দেন। তাদের নিয়ে আমি যাত্রা শুরু করি। নারী ফুটবলে সেই সময় রেহানার অনেক ভূমিকা রয়েছে। সুইনু সাবিনা সবাই সেই সময়ের খেলোয়াড়। 

খেলা ছাড়ার পর কোচিং করালেন এরপর প্রবাস জীবন বেছে ছিলেন। কেমন কাটছে প্রবাস ?
 
সান্টু: আমি খেলাধূলার সঙ্গেই রয়েছি। ডালাস ক্রিকেট দল গড়েছি। সেই দল প্রিমিয়ারে খেলে। বাচ্চাদের ফুটবল শেখাই। বাংলাদেশেও ৬-৭ বছর থেকে ফুটবলের কাজ শুরু করতে হবে। এটা আমি বাংলাদেশে করতে চাই, এজন্যই এসেছি ( আর্জেন্টিনার বাংলাদেশ আগমন নিয়ে মূলত)। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান জানে বাবা খেলাধুলা ছাড়া বাঁচবে না। তাই তারা এই বয়সেও আমাকে বাধা দেয় না জানে খেলাধুলা নিয়ে থাকলে ভালো থাকবে।

এজেড/এফআই