দেশের ফুটবল অঙ্গনে আবারও কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পুরুষ ফুটবলের ক্রমাগত ব্যর্থতার মধ্যে আলোকবর্তিকার নাম নারী ফুটবল। সেখানে সাফল্যের মূল কারিগর গোলাম রব্বানী ছোটন আর সাবিনাদের কোচিং করাতে চান না বলে জানিয়েছেন।

কেন এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ছোটন? শনিবার বিকেলে এ প্রসঙ্গে এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন সফল ও আলোচিত এই কোচ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। 

ঢাকা পোস্ট : নারী ফুটবল দল ও ছোটন প্রায় সমার্থক ছিল। ওতপ্রোত এ সম্পর্ক ছিন্ন করছেন?

ছোটন : কোচিং জীবনটাই এমন। যে কোনো সময় দায়িত্ব ছাড়ার বা ছাড়তে হতে পারার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি এবার দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। 

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অনুশীলন আপনাকে ছাড়া কখনো হয়নি। আজই প্রথম আপনি অনুপস্থিত। ফুটবলারদের জন্য খারাপ লাগছে না?

ছোটন : আমি যখন যেখানে থাকি শতভাগ দিই। নারী ফুটবলারদের অনুশীলন করিয়েছি প্রচন্ড শরীর খারাপ নিয়েও। তাও অনুশীলন বাদ দিইনি। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাজ করব না। তাই সেটা নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই আমার। আমি যখন যেটা ছেড়ে দিই, সেটা নিয়ে বা সেই সম্পর্কে আর ভাবি না। 

ঢাকা পোস্ট : ছেড়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে ক্লান্তি এবং পরিবারকে সময় দেওয়ার কথা বলেছেন, আসলেই কি এটা নাকি অন্য কিছু রয়েছে?  

ছোটন : আমি অবশ্যই ক্লান্ত। ভোর চারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুশীলন করানো সহজ বিষয় নয়। এই কাজটি আমি সাত বছর ধরেই করছি। ফলে আমার মধ্যে মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তি ভর করছে। আবার চাপও বাড়ছে। নারী দল সাফল্য পাচ্ছে। এখানে সবাই শিরোপা চায়। একদিকে ক্লান্তি, অন্যদিকে চাপ- সব একসঙ্গে নেয়া আর সম্ভব নয়।

ঢাকা পোস্ট : ২০১৬ সালে আপনার কোচিংয়ে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে মূল পর্বে ওঠে বাংলাদেশ। এরপর ব্রিটিশ ট্যাকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলি যোগ দেন। তার অন্তর্ভুক্তির পর থেকে আপনাদের ওপর কর্তৃত্ব করার ঘটনা শোনা যায়। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?  

ছোটন : আমার কারো ওপর কোনো অভিযোগ নেই। তাছাড়া সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক।

আরও পড়ুন >> অসন্তোষ নিয়ে কোচের দায়িত্ব ছাড়ছেন ছোটন

ঢাকা পোস্ট : সে টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর হলেও নারী দলেই বেশি কাজ করে। আপনার চেয়ে তার বেতন অনেক গুণ বেশি। এ নিয়ে কোনো অসন্তোষ?

ছোটন : এখানে বেতন বা টাকা পয়সার কোনো ব্যাপার নয়।

ঢাকা পোস্ট : তারপরও দিন শেষে পেশাদার জগতে অর্থটাই মূখ্য। বিদেশি কোচ, স্টাফদের যেমন আর্থিক সম্মানী ও সুবিধা দেশিদের ক্ষেত্রে ততটা নয়...

ছোটন : এটা শুধু ফুটবলে নয় পুরো ক্রীড়াঙ্গনেই দেশি কোচদের মূল্যায়ন কম। দেশিরা বিদেশিদের চেয়ে যোগ্য হলেও অর্থ, ক্ষমতা বিদেশিদেরই বেশি দেওয়া হয়। এটা আসলে আমাদের মানসিক সংস্কৃতির বিষয়। আমাদের খেলাধুলা যারা পরিচালনা করেন তারা মনে করেন বিদেশিরাই হয়তো প্রকৃত যোগ্য।

ঢাকা পোস্ট : আর্থিক অপ্রাপ্তি এবং নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করে গেছেন। যখন নারী ফুটবল সাফল্যের দিকে হাঁটছে তখন আপনার প্রস্থান কেন?

ছোটন : এটা ভালো প্রশ্ন করেছেন। নারী ফুটবলের জন্য আমি অনেক ত্যাগ করেছি। সেই ত্যাগগুলো না হলে নারী ফুটবল এই পর্যায়ে আসত না। যে মেয়েরা লাথি দিতে পারত না, তারা এখন ছন্দময় ফুটবল খেলে। তাদেরকে এখন দেশের বা বিদেশের যে কোনো কোচ কোচিং করাতে পারবেন। গত সেপ্টেম্বরে সাফের পরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট ছিল। এখন কয়েক মাস সেই ধরনের ব্যস্ততা ও সূচি নেই। এজন্য এখন ছাড়ার উপযুক্ত সময় মনে করছি।

ঢাকা পোস্ট : আপনার ফেডারেশনের পথ চলায় নারী উইং কমিটির ভূমিকা কেমন?

ছোটন : নারী উইং সবসময় সহায়তা করেছে। বিশেষ করে কিরণ আপার সহযোগিতা না থাকলে নারী ফুটবল নিয়ে এত কাজ করা সম্ভব হতো না।

ঢাকা পোস্ট : শুধু ফুটবল নয়, গোটা ক্রীড়াঙ্গনেই আপনি নিষ্ঠাবান কোচ হিসেবে স্বীকৃত। কয়েক মাস আপনি বিশ্রাম নিতে চেয়েছেন। কর্মসংস্থানের বিকল্প নিশ্চিত না হলে আপনার পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে সমস্যা হবে না তো?   

ছোটন : কিছুটা তো কষ্ট হবেই, এরপরও আমি আপাতত কয়েক মাস একটু নিজেকে বিশ্রাম দিতে চাই। একদিকে কষ্ট হলেও আরেক দিকে শান্তি থাকবে, কোনো প্রশ্নের সামনে নেই। খেলোয়াড়রা যারা সিনিয়র হয়েছে তারা প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে স্যার কবে, কখন খেলা? এর উত্তর আমার কাছে নেই। খেলোয়াড় ছাড়াও তো অন্যদেরও প্রশ্ন এবং নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। 

ঢাকা পোস্ট : সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের দুই সদস্য ফুটবল ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে খেলা ছেড়েছেন। আবার গতকাল একজন খেলা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। স্বপ্নার সঙ্গে আপনিও সিদ্ধান্ত নিলেন ফেডারেশন ছাড়ার। এগুলো কি পারষ্পরিক সম্পর্কযুক্ত? 

ছোটন : স্বপ্না প্রাপ্তবয়স্ক। সে তার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে কোনোটার সঙ্গে কোনোটার সম্পর্ক নেই।

ঢাকা পোস্ট : সাফের পর থেকে খেলোয়াড়রা কোনো ম্যাচ খেলতে পারেনি। তাদের মধ্যে হতাশা কেমন?

ছোটন : হতাশা তো রয়েছেই। খেলোয়াড়রা সব সময় খেলতে চায়। খেলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। তখন যদি খেলা বাতিল হয় তখন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় তার আর ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। 

ঢাকা পোস্ট : ফেডারেশন অনুরোধ করলেও আপনি সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন বলছেন। আপনি নারী ফুটবল কোচ হিসেবে স্বীকৃত। বসুন্ধরা কিংস ছাড়া অন্য কোথাও নারী ফুটবল নিয়ে কোচিং করানোর সুযোগ সেভাবে নেই। ৫৪ বছর বয়সে এসে আবার নতুন চ্যালেঞ্জে ফেললেন নিজেকে? 

ছোটন : মানুষের জীবন যতদিন আছে ততদিনই চ্যালেঞ্জ। আমি একজন কোচ। নারীদের পারলে পুরুষদেরও কোচিং করাতে পারব। আমাকে যারা যোগ্য মনে করবে, ডাকবে। আমার পছন্দ হলে কাজ করব।

আরও পড়ুন >> অভিমানে ফুটবলকে বিদায় সাফজয়ী স্বপ্নার!

ঢাকা পোস্ট : এ রকম কোনো ক্লাব বা সংস্থার সঙ্গে কি আলোচনা হয়েছে? 

ছোটন : গত বছর নভেম্বরে একটি ক্লাব ভালো প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন ফেডারেশন যোগদান করতে দেয়নি। এখন ফেডারেশন ছেড়ে দিচ্ছি, এখন আমি ফ্রি। যে ডাকবে ভালো লাগলে কাজ করব। 

এজেড/এইচজেএস