বাংলাদেশের শীর্ষ দুই জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান ও আবাহনী। দেশে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা খেলার তিনটি ইভেন্ট ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিতে এই দুই ক্লাবের রয়েছে অসংখ্য অর্জন। প্রতিটি কীর্তির স্মারক হিসেবে প্রচুর ট্রফিও জিতেছে এ দুই ক্লাব। কিন্তু আবেগ-ভালোবাসার এসব ট্রফির অনেকগুলোই এখন তাদের সংরক্ষেণে নেই। কেন নেই, সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই ক্লাব-সংশ্লিষ্টদের কাছে। 

একেকটি ট্রফিতে লুকিয়ে থাকে খেলোয়াড়, কোচ, সমর্থক ও কর্মকর্তাদের শ্রম, স্বপ্ন, আবেগ-ভালোবাসা। ট্রফির সঙ্গে এসব আবেগ অনুভূতি আর অর্জন বয়ে বেড়ায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাবের অর্জিত অনেক ট্রফি নেই- এটা মানতে পারছেন না সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও ক্লাব কর্মর্কর্তারা। তারা বলছেন এমন উদাসীনতা পেশাদার ক্লাবের জন্য মোটেই কাম্য নয়।

ট্রফি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে ক্লাব-সংশ্লিষ্টদের মুখে। সেগুলো হলো-  ক্লাবে ট্রফি সংরক্ষণের সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা ; ম্যাচ হারের পর সমর্থকদের হামলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া; সংস্কারের সময় কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়া; ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগের অভাব; চুরি হয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি ক্লাবগুলোর উদাসীনতা।

১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব স্বাধীনতার আগে থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে সুপরিচিত নাম। স্বাধীনতার আগেই ক্লাবটি ফুটবল এবং ভলিবলে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির দলীয় খেলার পাশাপাশি ইনডোর গেমস দাবাতেও ছিল তাদের বিশাল সাফল্য। ১৯৭৭ সালে দাবার প্রথম বিভাগের অভিষেক আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহামেডান। এছাড়া ব্যাডমিন্টন কোর্টেও ছিল ক্লাবটির দাপট। বাংলাদেশে কারাতে বিস্তৃতির পেছনেও মোহামেডানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এসব খেলায় অর্জিত চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপসহ শত শত স্মারকের বদলে মোহামেডানে এখন সর্বসাকুল্যে ট্রফির সংখ্যা মাত্র ষাটের মতো!

ট্রফি হারানোর কথা শুনে বিস্মিত মোহামেডান ক্লাব সংশ্লিষ্টরা

স্বাধীনতার আগে থেকেই মোহামেডানের সঙ্গে অদ্যবধি সম্পৃক্ত দুই কিংবদন্তী ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। মোহামেডানের অন্যতম মহীরুহ প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ট্রফির স্বল্পতা সম্পর্কে বলেন, ‘এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। একবার আমাদের ক্লাবে অগ্নিকান্ড হয়েছিল (ওয়ারীর বিপক্ষে ১৯৭৯ সালে ম্যাচ হারের পর সমর্থকরা তান্ডব চালিয়েছিলেন তৎকালীন ক্লাব টেন্টে)। এতে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ট্রফিগুলোর প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও আমাদের ক্লাবে ট্রফি সংরক্ষণের সংস্কৃতিও কখনও গড়ে ওঠেনি।’ 

প্রতাপ শঙ্কর হাজরা-পিন্টুরা খেলা ছাড়ার পর কর্মকর্তা হিসেবে মোহামেডানের সঙ্গে কয়েক দশক ধরেই সম্পৃক্ত আছেন। নিজেরা কর্মকর্তা হয়েও ট্রফিগুলো সংরক্ষিত না থাকার কারণ সম্পর্কে হাজরার মন্তব্য, ‘আমরা ক্লাবের সঙ্গে থাকলেও নীতি নির্ধারণী বা মূল দায়িত্বে কখনও ছিলাম না। ক্লাবের ইতিহাস নিয়ে সারওয়ারই (সাবেক খেলোয়াড় ও পরিচালক) ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কাজ করেছিল।’ 

এসব ট্রফি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে ক্লাব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে। সেগুলো হলো- ক্লাবে ট্রফি সংরক্ষণের সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা; ম্যাচ হারের পর সমর্থকদের হামলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া; সংস্কারের সময় কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়া; ইতিহাস সংরক্ষণে কেবল উদ্যোগের অভাব; চুরি হয়ে যাওয়া এবং ক্লাবগুলোর উদাসীনতা।
মোহামেডানের অর্জিত ট্রফির একাংশ

মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড় ও সাবেক পরিচালক (বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সাবেক সভাপতি) সারওয়ার হোসেন ক্লাবের ট্রফির স্বল্পতা সম্পর্কে বলেন, ‘১৯৮৭ সালে স্টেডিয়াম এলাকা থেকে মোহামেডান ক্লাব মতিঝিল এলাকায় আসে। সেই সময় কিছু ট্রফি মিসিং থাকতে পারে। এই মতিঝিল টেন্টেও দুবার সংস্কার হয়েছে। তখনও কিছু হারিয়ে যেতে পারে। ২০১১ সালের পর থেকে ট্রফির জন্য বোর্ড রুমে আলাদা কর্ণার করা হয়েছে। যা ট্রফি আছে, এখন সেখানেই সংরক্ষিত।’

মোহামেডান ক্লাবের বোর্ড রুমের দুই পাশে কিছু ট্রফি রয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ পুরনো ট্রফির মধ্যে ১৯৯০ সালের একটি রয়েছে। সত্তর-নব্বই দশকের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির কোনো ট্রফি চোখে পড়েনি। ১৯৯০ সাল পরবর্তী বেশ কিছু ট্রফি রয়েছে সেগুলোও খুব এলেমেলোভাবে। মোহামেডান ক্লাবের ফুটবলের সর্বশেষ সাফল্যময় মৌসুম ২০০২ সাল। সেই লিগ জয়ের ট্রফিও নেই ক্লাবে। ক্লাব সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য, মতিঝিল টেন্টে দুটি রুমে গোডাউনের মধ্যে অনেক ট্রফি ছিল। ট্রফি ভর্তি রুম কিভাবে শূন্য হয়ে পড়ল এ নিয়ে বিস্ময় ক্লাব স্টাফ থেকে কর্মকর্তাদেরও। মোহামেডানের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির অনেক সাবেক খেলোয়াড় বিষয়টিকে তদন্তসাপেক্ষ বলে মনে করেন, ‘কীভাবে এত ট্রফি কমল এই বিষয়ে ক্লাবের একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকা দরকার। এজন্য একটি তদন্ত হওয়া দরকার।’

মোহামেডানের অন্যতম মহীরুহ প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ট্রফির স্বল্পতা সম্পর্কে বলেন, ‘এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। একবার আমাদের ক্লাবে অগ্নিকান্ড হয়েছিল (ওয়ারীর বিপক্ষে ১৯৭৯ সালে ম্যাচ হারের পর সমর্থকরা তান্ডব চালিয়েছিলেন তৎকালীন ক্লাব টেন্টে)। এতে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ট্রফিগুলোর প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও আমাদের ক্লাবে ট্রফি সংরক্ষণের সংস্কৃতিও কখনও গড়ে উঠেনি।’ 
মোহামেডানের সংরক্ষিত ট্রফি

অর্ধেকেরও বেশি ট্রফি নেই আবাহনীর!

মোহামেডান ক্লাবের জায়গা দুয়েকবার বদল হলেও দেশের আরেক জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধানমন্ডিতে অবস্থিত। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি এই তিন খেলার পাশাপাশি টেবিল টেনিসেও অসংখ্য শিরোপা জিতেছে। চ্যাম্পিয়ন, রানার্স-আপ ও নানা ট্রফি মিলিয়ে গত ৫০ বছরে আবাহনীর স্মারকের সংখ্যা কয়েকশ। তন্মধ্যে এখন আবাহনীতে সর্বসাকুল্যে ট্রফি আছে দেড়শ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি ট্রফি সংরক্ষিত আছে আবাহনীর।

সত্তরের দশক থেকে আবাহনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। আবাহনীর সাবেক ক্রিকেট ম্যানেজার ট্রফির স্বল্পতা সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের ক্লাবে একবার এসি ভেঙে চোর প্রবেশ করেছিল। সেই সময় অনেক ট্রফি চুরি হয়ে যায়।’ 

আবাহনীর সংরক্ষিত ট্রফির শোকেজ

প্রায় পাঁচ দশক আবাহনীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুভাস সোম। তার দেওয়া তথ্যমতে, আবাহনী ওই চুরির জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরিও দায়ের করেছিল। চুরি হওয়া বেশ কয়েকটি ট্রফি পরে উদ্ধারও করেছে আবাহনী। ক্লাব সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকায় ভাঙারি (পুরাতন জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়) দোকানে নেমপ্লেট ছাড়া কিছু ভাঙা ট্রফি উদ্ধার করা হয়। এরপরও প্রায় অর্ধেকের মতো ট্রফি নেই বলে জানিয়েছেন তারা।

মোহামেডানের বোর্ড রুমের মতো আবাহনীর বোর্ড রুমেও ট্রফি এলেমেলোভাবে সজ্জিত। আবাহনীর বোর্ড রুমের মধ্যে কয়েক সারিতে শতাধিক ট্রফি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ট্রফি দেখা গেল ১৯৮৫ সালের ফেডারেশন কাপ। ওই বছরেই আবাহনী স্বাধীনতা উত্তর প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই ট্রফিও ক্লাবে দেখা যায়নি। ইমতিয়াজ সুলতান জনি এখন মোহামেডানের কর্মকর্তা হলেও তার ক্যারিয়ারে সোনালী সময় কেটেছে আবাহনীতে। ১৯৮৫ সালে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের এই অধিনায়ক বলেন, ‘এত বড় একটি ইতিহাসের স্মারক ট্রফি নেই শুনে খারাপ লাগছে। এটা শুধু ক্লাব নয়, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম বড় ইতিহাস।’ 

১৯৮৫ সালের আগে আবাহনীর ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির কোনো ট্রফি দেখা যায়নি। এরপরও বেশ কয়েক বছরের অনেক ট্রফি নেই। ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রায় সব ট্রফিই ক্লাবটির সংরক্ষণে রয়েছে।

রয়েছে আন্তর্জাতিক সাফল্যও

আবাহনী-মোহামেডানের শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও রয়েছে অনেক সাফল্য। বিশেষ করে ফুটবল ও হকিতে দুই ক্লাবের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ট্রফি রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের প্রথম ফুটবল দল হিসেবে দেশের বাইরে থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি এনেছিল মোহামেডান (১৯৮১ সালে আরামবাগ নেপালের আনফা কাপে রানার্স-আপ)। ১৯৮২ সালে পাওয়া আশীষ জব্বার ট্রফিও নেই মোহামেডানে (১৯৮২ সালে লিগে ২৭ গোল করে আশীষ জব্বার টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার আব্দুস সালাম মুর্শেদী)। এদিকে, আবাহনী ফুটবলে নাগজি ট্রফি, বরদুলই ও চার্মস কাপ জিতেছিল। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে চার্মস কাপের ট্রফিটি শুধু সংরক্ষণে দেখা গেছে।
 
দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাবে নানা কারণে ট্রফি দিনকে দিন কমছে। দুই ক্লাব সংশ্লিষ্ট অনেকের দৃষ্টিতে এর পেছনে মূল কারণ উদাসীনতা। সেই উদাসীনতার একটি অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিলেন আবাহনীর সাবেক ফুটবলার কাজী আনোয়ার, ‘কিছুদিন আগে একটি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ক্লাবে এসেছে। ট্রফিটি নিয়ে এসেছিল একজন ক্লাব স্টাফ। ট্রফিটি নিয়ে অনেকে ছবি তুলল এবং পড়েও ছিল সেভাবে।’

মোহামেডানের চিত্রও কাছাকাছি। সম্প্রতি ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়নের ট্রফি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বোর্ড রুমে আসেনি। সেটি ক্লাব অধিনায়ক সুলেমান দিয়াবাতের রুমেই রয়েছে।  

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা ক্লাবে তার বিচরণ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তার বক্তব্য, ‘ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে এর ঐতিহ্য বহন করতে হয়। ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ট্রফি না থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম তা জানবে কীভাবে? সারা বিশ্বেই পুরনো ক্লাবগুলোতে জাদুঘরে জার্সি ও ট্রফি সংরক্ষিত থাকে। দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী-মোহামেডানেও এমনটা করা উচিত।’

এজেড/এএইচএস