জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ইলিয়াস এখন ইউপি চেয়ারম্যান
সালটা ১৯৭৯। স্থানীয় একটি লীগের ফাইনাল ম্যাচে খেলতে গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি ও তৎকালীন আবাহনীর তারকা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন। সেবার তার সঙ্গে গিয়েছিলেন আরেক তারকা ফুটবলার খোরশেদ আলম বাবুল, অমলেশ সেনসহ ক্লাবের সব খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। খেলাটি ছিল স্থানীয় টিম ফ্রেন্ডস ক্লাব বনাম জুবিলেন রেঞ্জার্সের সঙ্গে। ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষে খেলেছিলেন সালাউদ্দিন, বাবুলদের মত তারকারা। এসব তারকা খেলোয়াড়দের বিপক্ষে জুবিলেন রেঞ্জার্সের হয়ে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের বিশ মিনিট বাকি থাকতে মাঠে নেমেছিলেন গোপালগঞ্জের ছেলে সতেরো বছর বয়সী ইলিয়াস হোসেন।
মিডফিল্ডার হিসেবে বিশ মিনিট ধরেই মাঠ কাঁপিয়ে ছিলেন মধুমতী নদী পাড়ের ছেলে ইলিয়াস। সেদিন ইলিয়াসের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে আবাহনীর কর্মকর্তা, খেলোয়াড় কাজী সালাউদ্দিন ও খোরশেদ আলম বাবুলসহ প্রধান কোচ আলী ইমাম ঢাকায় আসার অফার দেন ইলিয়াসকে। এরপরের বছরই ডাক পান আবাহনী ক্রীড়া চক্র থেকে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ইলিয়াসকে।
বিজ্ঞাপন
পুরো আশির দশকে নিজের পায়ের জাদুতে মাঠ কাঁপিয়েছেন তিনি। আশির দশকের শুরুতে আবাহনী দিয়ে শুরু করে আজাদ, ঢাকা ওয়ান্ডার্স, মোহামেডান হয়ে জাতীয় দলে খেলেছেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়কও। আশির দশকে মাঠ কাঁপানো এই ফুটবলার ইলিয়াস এখন একজন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।
আশির দশকে যেমন নিজের পায়ের জাদুতে মাঠে থাকা দর্শককে মুগ্ধ করতেন। তেমনি নিজের নেতৃত্বের গুণাবলী দিয়ে মন জয় করেছেন নিজ এলাকার সাধারণ মানুষের। ইলিয়াস গোপালগঞ্জ জেলার একমাত্র জাতীয় দলের ফুটবলার। জানা গেছে, ১৯৬২ সালে গোপালগঞ্জ সদরের হরিদাসপুর ইউনিয়নের খাগাইল গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন ইলিয়াস। ইলিয়াস হোসেনের বাবা ছিলেন একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান। ১৯৭৯ সালে ১৭ বছর বয়সে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ক্লাবের কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের মন জয় করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ইলিয়াসের। ১৯৮০ সালে আবাহনীতে জুনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
এরপর ১৯৮১ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। পরের বছর ঢাকা ওয়েন্ডার্স ক্লাবে যান ইলিয়াস। ওই বছরই জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পান তিনি। ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে প্রথম জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামার সুযোগ পান ইলিয়াস। জাতীয় দলে থাকাকালীন ডাক পান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষ থেকে। মোহামেডানের ইলিয়াস নামেই পরিচিত ছিলেন আশির দশকে। জাতীয় দলেরও নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইলিয়াসের গোলে থাইল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে অধিনায়ক হিসেবে লিগ শিরোপা জিতিয়েছিলেন মোহামেডানকে। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এক মেয়াদে জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়া শেষে ১৯৯১ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন গোপালগঞ্জের এই কৃতি সন্তান। এরপর পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেন ইলিয়াস। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু নোংরা রাজনীতি কখনোই তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। তাই তো ইউপি নির্বাচিত হওয়ার পাঁচ বছর পর রাজনীতি থেকে আড়ালে চলে যান তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর এলাকার মানুষের অনুরোধে আবারও নির্বাচন করেন তিনি। এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বর্তমানে নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
আশির দশকে যেভাবে পায়ের জাদুতে মাঠে থাকা দর্শককে মাতিয়ে রাখতেন ঠিক তেমনই ডায়নামিক নেতৃত্ব দিয়ে নিজ ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনা করছেন তিনি। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন সাবেক এই ফুটবলার। কথা হয় ফুটবল জীবনের স্মৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে।
ঢাকা পোস্ট - সালাউদ্দিনদের আপনার খেলা দেখে মুগ্ধ হওয়া এবং ঢাকায় ডেকে নেওয়ার ঘটনাটা যদি একটু বলতে?
ইলিয়াস হোসেন - আমার জন্মের কিছুদিন পর গ্রাম ছেড়ে মহুকুমা গোপালগঞ্জে চলে আসে আমার পরিবার। তখন এ শহরে অনেক মাঠ ছিল। বর্তমান মডেল স্কুলে আমাদের সিনিয়ররা খেলতেন। মাঠে সুযোগ না পেয়ে আমরা শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতী নদী পাড়ে খেলতাম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খুব ভালো খেলতাম আমি। তখন এলাকায় অনেক ফুটবল টিম ছিল। ভালো খেলার কারণে নামকরা অনেক টিমে আমার জায়গা হয়ে যেত। তখন আমার বয়স ১৬-১৭। স্থানীয় একটা লীগের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। খেলাটি ছিল ফ্রেন্ডস ক্লাব ও জুবিলেন রেঞ্জার্সের। আমি জুবিলেন রেঞ্জার্সের অতিরিক্ত খেলোয়াড় ছিলাম। ওই ম্যাচে আমার বিপক্ষ দলে ফ্রেন্ডস ক্লাবে খেলতে আসেন ঢাকার আবহনী ক্লাবের তারকা খেলোয়াড় সালাউদ্দিন ভাই খোরশেদ আলম বাবুল ও ক্লাবের কোচ অমল সেন।
সেই ম্যাচে আমি বদলি প্লেয়ার হিসেবে মাঠে নেমে বিশ মিনিটের মত খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিশ মিনিট খেলে একটি গোল করেছিলাম। সেই ম্যাচে আমরা বিপক্ষ দল ফ্রেন্ডস ক্লাবের কাছে ২- ১ গোলে হেরে যাই। কিন্তু আমার বিশ মিনিটের খেলায় মুগ্ধ হয়েছিলেন আবাহনীর খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। ম্যাচ শেষে আমাকে ডেকে নিয়ে যান কাজী সালাউদ্দিন, খোরশেদ আলম বাবুল ভাই ও কোচ অমল দা। দেখে নিয়ে আমাকে ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন তারা। এরপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৮০ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ক্লাবের জুনিয়র প্লেয়ার হিসেবে যোগদান করি। এরপর আজাদ, ওয়ান্ডার্স, মোহামেডান, জাতীয় দলে খেলেছি। এর পাশাপাশি অনেক গুলো ক্লাবে খেলেছি আমি। দীর্ঘ এক দশক খেলে ১৯৯১ সালে অবসরে যাই আমি।
ঢাকা পোস্ট - দীর্ঘ এক দশকের ফুটবল জীবনের কোন স্মৃতিটা বেশি মনে পড়ে?
ইলিয়াস হোসেন - স্মৃতিটা খুব কষ্টের। কিন্তু এই স্মৃতিটা আমার সবসময় মনে পড়ে। ১৯৮৯ সালে সাফ গেমসের ফাইনালে উঠি আমরা। দলের অধিনায়ক ছিলাম আমি। সেবার প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ ছিল আমাদের। কিন্তু নিজেদের কিছু ভুলে ২-০ গোলে আমরা হেরে যাই। ট্রফি হাতছাড়া হয়ে যায় আমাদের। টিমের সবাই আশাবাদী ছিলাম আমরাই চ্যাম্পিয়ন হবো। এই স্মৃতিটা এখনো খুব কষ্ট দেয় আমাকে। সেদিন জিততে পারলে নামের পাশে সেরার তকমাটা লাগতো।
ঢাকা পোস্ট - ক্লাবে খেলেছেন অনেক বছর সেই অভিজ্ঞতা থেকে যদি কিছু বলতেন?
ইলিয়াস হোসেন - ১৯৮৩ পর থেকে একটানা আট বছর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেছি। ৮৯ থেকে ৯১ পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৮৬ সালটা আমার জন্য একটা স্বরণীয় বছর। সে বছর মোহামেডানের সাথে আবাহনী ক্লাবের খেলা ছিল। আবাহনীর সাথে ফাইনাল। আবাহনী আমাদের চেয়ে শক্তিশালী টিম ছিল। তার সাথে তারা আবার ভারত থেকে কিমা ওয়াকিরি তারপর মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যসহ তিনজনকে নিয়ে আসে মোহামেডানের সাথে খেলার জন্য। কিন্তু তারা আমাদের কাছে ২-০ গোলে হেরে যায়। দুই গোলের প্রথম গোলটা আমি করেছিলাম। অন্য গোলটি করেছিলেন আমাদের দলের মনু। ওইবার আমরা লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এই জয়টা ক্লাব ফুটবলে আমার কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকবে। এছাড়াও অনেক স্বরণীয় মূহূর্ত রয়েছে মোহামেডানের সাথে আমার। তা একবারে বলে শেষ করা যাবে না।
ঢাকা পোস্ট - জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে কেমন উপভোগ করেছেন?
ইলিয়াস হোসেন - ১৯৮৯ সালে আমি জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী এক বছরের একটু বেশি সময় আমি দলের অধিনায়কত্ব করেছি। তখন নিয়মটাই এমন ছিল। এখন তো নিয়ম বদলেছে। এখন সিলেকশন বডি ও ম্যানেজমেন্টই ঠিক করেন কে অধিনায়কত্ব করবেন। কিন্তু আমাদের সময় সেই সুযোগ ছিল না। তখন এক মেয়াদ করে সবাই কে সুযোগ দেওয়া হত। কারণ সবারই তো দলের অধিনায়কত্ব করতে মন চায়। তাই সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।
ঢাকা পোস্ট - ফুটবল ছেড়ে ইউপি রাজনীতিতে কিভাবে যুক্ত হলেন?
ইলিয়াস হোসেন - আমার বাবা হায়দার মিয়া ছিলেন হরিদাসপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার কিছুদিন পর আমার বাবা মারা যায়। তখন আমার বাবা রানিং চেয়ারম্যান। বাবার লাশ দাফন শেষে বাসায় আসার এলাকার লোকজন আমাকে পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করতে অনুরোধ করে। পরে আমি ৯৭ সালে নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। কিন্তু এই রাজনীতি কখনই আমার ভালো লাগতো না। নির্বাচিত হওয়ার পাঁচ বছর পর মেয়াদ শেষে আমি এই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াই। পরে দীর্ঘ সতেরো বছর পর আবার আমার এলাকার মানুষের অনুরোধে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেই। এ নির্বাচনেও আমি বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছি।
এফআই