কেউ বলে এলিয়েন, কেউ বলে সুপার ন্যাচারাল আবার কেউ বলে সুপার হিউম্যান। লিওনেল মেসি যে সাধারণ কেউ নন তা শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধও এক বাক্যে স্বীকার করবেন। আর্জেন্টাইন বিশ্বকাপজয়ীকে ‘লিওনেল গ্যালাক্সি’ এবং ‘মেসি ব্ল্যাকহোল’ নামেও ডাকা যায়। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলের মহাতারার জন্য উপমা দুটি আরও ছোট হয়ে গেল কি না!

২০০৪ সালে ক্লাব এবং ২০০৫-এ দেশের হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলতে নেমে আজ পর্যন্ত কি নেই তার ক্যারিয়ারে! ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন, ব্যক্তিগত পুরস্কারে শোকেজ ঠাসা। অনবরত নিন্দুকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হয়ে দেশের জন্য কিছু না করতে পারা ছেলেটা তো গত ২ বছরে অধরা সবকিছুই দিয়েছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে ২৮ বছর পর একটা কোপা আমেরিকা, একটা লা-ফিনালিসিমা কিংবা তার জন্মের পর যে ট্রফি তিনি দেশের হয়ে চোখেই দেখেননি। সেই ৩৬ বছরের সাধনার একটা সোনালি রঙ্গা বিশ্বট্রফি।

আর ক্লাবের হয়ে ৪৪টি ট্রফির মালিক যা করেছেন, করছেন এবং করবেন তার সাথে শুধু একজনেরই উপমা চলে, কিং মিডাস। যিনি যা-ই ছুঁয়ে দিতেন, তা-ই সোনা হয়ে যেতো। এক্ষেত্রেও তো বলা যায় ‘কিং লিওনেল মিডাস’।

ইউরোপে রাজত্ব করে রাজা পাড়ি জমালেন আমেরিকায়। রাজ্যের ব্যস্ততা, ভক্তদের আবদার, দায়িত্বের ভার থেকে একটু অবকাশ যাপন করবেন বলে। কিন্ত আসলেই কি তাই হয়েছে? অবকাশ যাপন তো হচ্ছেই না বনে গেলেন খোদ ‘আমেরিকান ফুটবলের কলম্বাস’। যার হাত ধরে আমেরিকান ফুটবলের নতুন পরিচয় ঘটছে। প্রতিপক্ষের দর্শকরা প্রতিপক্ষ দলকে সমর্থন দিতে আসে না, ফুটবল জাদুকরকে একনজর দেখতে আসে। অতি উৎসাহে কেউ চাকরী হারিয়েও খুশি হয়। মেসিও চুমু এঁকে দেন ট্রাফিক সিগনালে ভক্তের গালে।  

আমেরিকায় ফুটবলের গণজোয়ার উঠেছে মেসির হাত ধরে। 

যে ক্লাবটার কাছে কোনো ফাইনাল খেলা ‘আদার ব্যপারী হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার’ মতো ছিল। সেই ক্লাবটাকেই একা হাতে লিগস্ কাপের ফাইনালে তুললেন, ৭ ম্যাচে ১০ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে নিজে হলেন ‘বেস্ট প্লেয়ার’ এবং ‘টপ স্কোরার’। বার্সেলোনা ক্যারিয়ারে ৭৭৮ ম্যাচ খেলে মেসির গোল ৬৭২টি এবং অ্যাসিস্ট ২৬৯টি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে পিএসজিতে থেকে মেসি ৭৫ বার মাঠে নেমে ৩২টি গোলের সাথে করেন ৩৪টি অ্যাসিস্ট। আর ইন্টার মায়ামি ক্যারিয়ার তো সবে শুরু। এইযে এতো এতো অর্জন, এতোকিছু ‘লিওনেল মেসি’ নামটাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাহলে কি বলা যায় না ‘লিওনেল গ্যালাক্সি’?

‘মেসি ব্ল্যাকহোল’ কেন?

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে, এটা এমন একটি জিনিস যেখানে খুবই অল্প জায়গায় অনেক অনেক ভর বা চুম্বকশক্তি বা আকর্ষণ করার ক্ষমতা ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। এতই বেশী যে, কোনো কিছুই এর কাছ থেকে রক্ষা পায় না এমনকি সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন আলোও নয়! যা কিছুই তার সন্নিকটে আসে সবকিছুই নিজের মধ্যে টেনে নেয়। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ঠিক এমন।

পৃথিবীতে যারা ন্যূনতম ফুটবল বোঝে তারা কখনই মেসিকে ভাল না বেসে থাকতে পারবে না। আমি জোর গলাই বলছি না। নিজেকে প্রশ্ন করুন না একটু। মেসি তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেন। বিশ্বকাপের সময় চিরশত্রু দলের সমর্থকরাও চায়, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ না জিতলেও মেসি ভাল খেলুক। দলের সতীর্থদের কাছে তো মেসি একজন নেতা, ভাই, আইডল। এইযে রাজপথে যে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ধ্বনিতে স্লোগান হয়, তাদের নেতার জন্য এই ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ করতেও ২ সেকেন্ড ভাবেন না এমি, রোমেরো, মার্টিনেজ, ডি পলরা। এমি মার্টিনেজ তো একবার বলেছিলেন, ‘মেসি যখন কথা বলেন তখন সবাই চুপ হয়ে যায়, খোদ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হলেও চুপ হয়ে যায়।’ আর ডি পল? মেসির গায়ে কেউ ফুলের টোকা দেওয়াও বিদ্যমান, ডি পল হাজির হয়ে যান সেই ফুলকে মোকাবিলা করতে।

তিন যুগের আক্ষেপ ঘুচিয়ে আকাশী-সাদাদের সোনালি ট্রফি এনে দিয়েছেন খুদে জাদুকর।

বার্সেলোনায় যখন নিজের পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হলো তখন পাশে পেলেন বন্ধু-বড়ভাই, তখনকার সেলেসাও-বার্সা প্রিন্স রোনালদিনহোকে। ছোটভাই-বন্ধু মেসিকে নিজের কাঁধটা বাড়িয়ে দিয়ে উদযাপন করতেন একসঙ্গে। রোনালদিনহোর পর জমে উঠলো মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার ক্যামিস্ট্রি। সেই সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পরলে নস্টালজিয়ায় ফুটবল ভক্তদের চোখ কিংবা মনের কোনো কোণে কোথাও কি এক বিন্দুও জল ঝরবে না?
পরবর্তীতে সবাই ভেবেছিল প্যারিসেও একটা সুখের ঘর হবে বরপুত্রের। সবার চোখে লেগে থাকবে মেসি-নেইমার-এমবাপে ত্রয়ী। কিন্ত তা না হলেও যে এমবাপেকে মেসির প্রতিদ্বন্দী ভাবা হতো সেই এমবাপেকেই আদর-স্নেহ দিয়ে নিজেকে ভালবাসতে বাধ্য করেছেন বরপুত্র।

ইন্টার মায়ামি ছিল নতুন এক পরিবেশ। সবাই যখন ভাবছিল পারবেন তো মেসি সহজেই মানিয়ে নিতে? তখনই দেখা গেল নিজের প্রথম ম্যাচেই মাঠে নামার আগে নবসতীর্থ জোসেফ মার্টিনেজের সাথে খুঁনসুটিতে ব্যস্ত ভালবাসতে বাধ্য করা লোকটা। আর দলের মালিক ডেভিড ব্যাকহামের তো নয়নের মণি তিনি। এই যে বিশ্বজোড়া মানুষের ভালবাসা, সম্মানে অধিষ্ঠিত হন। তা কি এমনি এমনিই? নামটা লিওনেল মেসি বলেই? না। নামের জন্য, বংশ মর্যাদায় কেউ কিংবদন্তি হয়না। হয় তার গুণের জন্য।

লিওনেল মেসি যেমন সবুজ গালিচায় কাব্য লেখেন, রঙ-তুলির আঁচড় দেন। তেমনিই মানুষকে সম্মান দেন, ভালবাসা দেন। তিনি জানেন সম্মান কিভাবে পেতে হয়, ভালবাসতে বাধ্য করতে হয়। এইতো লিগস্ কাপ ফাইনাল জেতার পর চাইলেই তো তিনি ট্রফি নিতে উঠতে পারতেন মঞ্চে, তিনি তো অধিনায়ক। কিন্ত না, তিনি স্বাগত জানালেন দলের সাবেক অধিনায়ককে। ক্লাবের সাবেক অধিনায়ককে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দিয়ে বললেন, ট্রফিটা তুমিই তোলো। যদিও ইয়েডলিন তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু মেসি জানান দিলেন, সম্মান দিলে সম্মান কমে না বরং বাড়ে।

এর আগে পিএসজিতে ছোট ভাই-বন্ধুকে নিজের ১০ নম্বর জার্সিটি দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরুর ৩০ নম্বর জার্সি নিয়েছিলেন মেসি। যদিও নেইমার চেয়েছিলেন তার আইডল মেসির গায়ে চড়ুক ১০ নম্বর জার্সিটা। ইন্টার মায়ামির হয়ে মেসির মোট গোল থাকতো এখনও পর্যন্ত ১২টি। নিজের পেনাল্টি গোল উপহার দিয়েছেন তার মায়ামি সতীর্থদেরকে। নেইমার-সুয়ারেজ-এমবাপে-র‌্যামোস সবাই-ই পেয়েছেন মেসির এই ভালবাসা। তাইতো তারা মেসির এক কথায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ করতে দুইবার ভাবে না।

এরপরও কি বলবেন, মেসি একটা ব্ল্যাকহোল নন? একটু প্রশ্ন করুন তো নিজেকে? আমি বলবো, মেসি এলিয়েন, সুপার হিউম্যান, সুপার ন্যাচারাল কিচ্ছু নন। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচিত্তিনি একজন আস্ত একটা গ্যালাক্সি, আস্ত একটা ব্ল্যাকহোল।

লেখক:- আজিজুল হাকীম আশিক, ক্রীড়া সাংবাদিক