দেশ স্বাধীনের জন্য ফুটবলারদের লড়াই করার ঘটনা বিশ্বে বিরল। সেই বিরল কীর্তিই গড়েছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। ভারতে নানা প্রদেশে ম্যাচ খেলে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে আর্থিক সহায়তা করেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

জাকারিয়া পিন্টু, কাজী সালাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি স্বাধীনতা পদক পেলেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এখনো স্বাধীনতা পদক পায়নি। এই পদক না পেলেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সকল খেলোয়াড়ই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশের সকল ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্বাধীন বাংলা ফুটবলারদের সম্মাননা হিসেবে মাসিক ভাতা প্রদান করে আসছে। শুরু থেকেই এই ভাতার পরিমাণ ছিল মাসে ৩ হাজার টাকা। দুই দশকে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, মূল্যস্ফীতিও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাসিক ভাতা সেই ৩ হাজারই রয়ে গেছে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা এই সম্মানী প্রসঙ্গে বলেন, 'এই ভাতার সম্মানীর অঙ্ক অবশ্যই বাড়ানো উচিত। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে অনেকেই রয়েছে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় এবং অসুস্থতায় কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এই অঙ্ক বাড়লে তাদের অনেক উপকার হয়।’ ভাতার সম্মানী বৃদ্ধি নিয়ে তিনি একবার উদ্যোগও নিয়েছিলে, 'তখন বিরেণ শিকদার ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন। এই ভাতা বৃদ্ধির জন্য মিটিংও করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর বাড়েনি। এরপর আর উদ্যাগ নেয়া হয়নি।'

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বর্তমান সচিব পরিমল সিংহ অত্যন্ত চৌকস। তার প্রায় দুই বছরের মেয়াদে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক অচলায়তন ভেঙেছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ভাতার বিষয়টিও চোখ এড়ায়নি তার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা এই বিষয়টি অবগত এবং এটি নিয়ে কাজ করা হবে। দীর্ঘদিন থেকেই তাদের ভাতা মাসিক ৩ হাজার করে। সময়ের প্রেক্ষাপটে এখন এটি খুবই সামান্য। পর্যালোচনা করে এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে।'

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য শেখ আশরাফ আলী মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পান। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কয়েক দফা বেড়ে এখন মাসিক ২০ হাজার। মুক্তিযোদ্ধা ভাতার সঙ্গে তুলনা করে আশরাফ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ভাতা নিয়ে প্রস্তাব রাখেন, 'মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, তেমনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও বৃদ্ধি করতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় আমি মারা গেলে স্ত্রী-পরিবার পাবে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ভাতা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় মারা গেলেই স্থগিত। ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফুটবলারের মৃত্যুর পরও এটা পরিবারকে দিতে পারে।' ৩৪ জন ফুটবলারের মধ্যে অনেকেই মৃত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২০ জনের নামে চেক ইস্যু করে।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে তালিকা নেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কয়জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করেন। আবার স্বাধীন বাংলা ফুটবলারাও সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না তাদের মধ্যে কয়জন ভাতা পান। শীর্ষ স্থানীয়দের মধ্যে অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, শেখ আশরাফ আলী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করেন। তারা এটিও নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার আগে থেকেই তারা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সম্মানী পেয়ে আসছেন, 'জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ভাতাই আমরা প্রথম পেয়ে আসছি। কয়েকজন আমরা মুক্তিযুদ্ধ ভাতাও পাই। যারা শুধু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ভাতাই নেন তাদের অন্তত ৩ হাজারের পরিবর্তে আরো বেশি ভাতা দেওয়া প্রয়োজন।'

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ করেন আবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সম্মানীও নেন। প্রায় একই বিষয়ে সরকারের দুই জায়গায় থেকে সম্মানী প্রদানের রেওয়াজ খুব একটা নেই। এই বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব বলেন, 'এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটিও খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।'

মাসিক ভাতার সম্মানী ছাড়াও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে হকি স্টেডিয়ামে একটি অফিসও দিয়েছে। গত এক যুগ ধরে সেই অফিস অনেকটাই পরিত্যক্ত। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কারোরই সেই অফিসে যাতায়াত নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু অফিসের নেপথ্যের কারণ এবং বর্তমান কার্যকারিতা নিয়ে বলেন, 'এনএসসির চেক আনতে অনেকে জেলা থেকে আসতো। এখানে এসে যাতে বিশ্রাম নিতে পারে এবং স্টেডিয়াম এলাকায় আসলে যাতে একটা নিজস্ব জায়গা থাকে এই ভেবে অধিনায়ক পিন্টু ভাই এটা নিয়েছিলেন। বাস্তবিক অর্থে এটা আসলে কোনো কার্যকর কিছুতে পরিণত হয়নি।'

শুরুর দিকে প্রতি মাসেই স্বাধীন বাংলা ফুটবলারদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চেক আনতে যেতে হতো। তিন হাজার টাকার চেক আনতে জেলা পর্যায়ে থাকা অনেকের যাওয়া আসাতেই ব্যয় হতো হাজার খানেক টাকা। গত কয়েক বছর ধরে বছরে ২ বার ১৮ হাজার টাকার চেক প্রদান করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সবাই এখন বৃদ্ধ এবং অনেকেই অসুস্থ। তাদের পক্ষে এসে চেক সংগ্রহ করাটাও কঠিন। বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'আমরা সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিতে চাই। কিন্তু অনেকে সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট দিতে পারেনি। অনেকে নিজে, আবার অনেকে কাউকে পাঠিয়ে চেক সংগ্রহ করে।'

এজেড/এইচজেএস