প্রবাদের আলোকে বললে দুটো কথাই বলা যায়। কারো মতে, বুড়ো হাড়ের ভেলকি। আবার কেউ বলতে পারেন, পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। ঘটনাবহুল ২০২৩ সালের শুরুতে নিজের ক্যারিয়ারের ইউরোপ পর্ব শেষ করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বছরের মাঝপথে একই ভাগ্য বরণ করেছেন লিওনেল মেসিও। কিন্তু ইউরোপ ছাড়লেও বুড়িয়ে যাননি কেউই।

রোনালদো আলো ছড়িয়েছেন সৌদি লিগে গোলের পর গোল করে। আর মেসি ইন্টার মায়ামিকে আপন করেছেন, খেলেছেন নিজের মত করে। ইনজুরির কারণে বেশ কিছু ম্যাচ খেলতে না পারলেও নিজের ক্লাবকে তাদের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা এনে দিয়েছেন। ইউরোপ ছাড়লেও নিজেদের উপস্থিতি প্রতিনিয়ত জানান দিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের বড় দুই তারকা।   

তবে এসব ছাপিয়ে ফুটবলের সবচেয়ে বড় খবর ছিল সৌদি আরব। এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে একঝাক পরিচিত তারকাদের বাড়তি অর্থের টোপ দিয়ে নিজেদের লিগে ভিড়িয়েছিল দলটি। তাদের এমন আর্থিক ঝনঝনানির কবলে রীতিমত শঙ্কায় দিন পার করেছে ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা। ম্যানসিটি থেকে রিয়াল মাদ্রিদ, কেউই রক্ষা পায়নি দলবদলের সৌদি ঝড় থেকে। 

আর এককভাবে পুরো বছর দাপট দেখিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। লিগ শিরোপা, এফএ কাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে প্রায় দুই যুগ পর ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয় করেছে তারা। এরপর ঘরে তুলেছে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপাও। 

সৌদিতেও বর্ণিল রোনালদো 

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যেনো এক দুরন্ত ঘোড়া। বয়স তার জন্য কেবলই একটা সংখ্যা যেন। ৩৮ ছুঁইছুঁই করছে পর্তুগালের মাদেইরা থেকে উঠে আসা এই ফুটবলারের। তবে তাতেও ভাটা পড়েনি পারফরম্যান্সে। রোনালদো এখনও দুর্দান্ত আর নিখুঁত। সৌদি প্রো লিগে তার যোগদানের পর চিত্রটা পুরো পালটে গিয়েছে। 

এই বয়সে এসেও রোনালদোর গোলের ক্ষুধা ফুটবল ভক্তদের বিস্মিত করেছে, মোহিত করেছে। সৌদি প্রো লিগের আল-নাসরের হয়ে ৪৮ ম্যাচে করেছেন ৪১ গোল। চলতি মৌসুমে লিগে ১৬ ম্যাচে ১৭ গোল করেছেন। আছে ৯ অ্যাসিস্ট। জিতেছেন আরব কাপের শিরোপা। ছন্দে আছেন পর্তুগালের জার্সিতেও। সবমিলিয়ে ২০২৩ সালে রোনালদো খেলেছেন ৫৭ ম্যাচ। গোল করেছেন ৫১ টি। করিয়েছেন ১৫টি। 

সৌদি প্রো লিগের উত্থান 

বিশ্বকাপের আগে বিতর্কিত সাক্ষাৎকার দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন রোনালদো। যোগ দেন সৌদি আরবের ক্লাব আল-নাসরে। সেটাই যেন শুরু। সৌদি আরবে আসতে শুরু করেছেন একের পর এক ফুটবল তারকা। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাসী পিএফআই প্রকল্পের অংশ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে পা রাখেন বিশ্ব ফুটবলের নামি সব তারকারা। 

গ্রীষ্মের দলবদলে করিম বেনজেমা, সাদিও মানে, এনগালো কান্তে, রবার্তো ফিরমিনো থেকে শুরু করে, মুসা দেম্বেলে, রুবেন নেভেস, কালিদু কুলিবালি, মার্সেলো ব্রজোভিচ, অ্যালেক্স তেলেসরা চলে আসেন সৌদি লিগে।  এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার জুনিয়র। এই তালিকা ভবিষ্যতে আরও লম্বা, হতে পারে সেটা বলাই যায়।

কেবল ত্রিশোর্ধ্ব ফুটবলাররাই এমন সিদ্ধান্ত নেননি, ২০ বছরের আশপাশে থাকা নেভেস, সার্গেস মিলিনকোভিচ, অ্যালান সেইন্ট-ম্যাক্সিমিন, ফ্র্যাঙ্ক কেসিয়ের মতো ফুটবলাররাও ইউরোপের ফুটবলে ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সৌদি ক্লাবকে। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সৌদি লিগের ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বাবদ চলতি গ্রীষ্মে ৪৮ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এর ফলে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল লিগের কাতারে চলে গেছে সৌদি ফুটবল লিগ। কেবল ফুটবলই নয়, গলফ, ফর্মুলা ওয়ান মোটর রেসিং, বক্সিংসহ আরও বেশকিছু খেলায় তারা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন।

লিওনেল মেসি এখন মায়ামির 

ইউরোপিয়ান ফুটবলের পর্ব শেষ করেছেন লিওনেল মেসিও। আর্জেন্টিনা আর বার্সেলোনার হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপা জেতা মেসি চলতি বছরই পাড়ি জমিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার বা এমএলএসে। বহু জলঘোলা করার পরেই ডেভিড বেকহ্যামের মালিকানাধীন দলে যুক্ত হন তিনি। 

লিগ কাপ দিয়েই শুরু হয় মেসির মায়ামি পর্ব। নিজের প্রথম সাত ম্যাচেই পেয়েছেন শিরোপার দেখা। জাতীয় দলের হয়েও সময়টা দারুণ কেটেছে তার। মৌসুমের শেষ দিকে অবশ্য ইনজুরিতে ছিলেন। গোলের সংখ্যাতেও অনেকটা পিছিয়ে ছিলেন সবার তুলনায়। তবু মেসি তো মেসি।

ক্যারিয়ারে রেকর্ড ৮ম ব্যালন ডি অর জয় করেছেন এই বছরেই। সপ্তম স্বর্গ ছাপিয়ে অন্য উচ্চতায় চলে যান লিওনেল মেসি। প্যারিসের জমকালো এক রাতে মেসি জিতলেন নিজের অষ্টম ব্যালন ডি অর। যে কীর্তিতে মেসি আগেই ছিলেন অনন্য, এবার সেটাকেই বাড়িয়ে নিলেন অনেকখানি! 

ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন আগেই জানিয়েছিল এবারের বিজয়ী নির্ধারণে বছর নয়, আমলে নেওয়া হবে মৌসুম। এরপরই মূলত ব্যালন হয়ে যায় এক ঘোড়ার দৌড়! মাঝে আর্লিং হালান্ডের ট্রেবল জয় কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানালেও শেষ পর্যন্ত পার্থক্য নির্ণয় করে দিয়েছে সেই বিশ্বকাপটাই। 

ব্যালন ডি’অরের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২২ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই সময়কে। এ সময়ে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি পিএসজির হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ জিতেছেন মেসি।

ম্যানচেস্টার সিটির দাপট 

ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে চলতি বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল ম্যাচটি ১-০ গোলে জিতেছিল ম্যানচেস্টার সিটি। তাতেই রচনা হয় ইতিহাস প্রথমবারের মতো ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে শিরোপা জয় হয় তাদের। একইসঙ্গে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যান ইউনাইটেডের পর দ্বিতীয় ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবলের রেকর্ড সিটির।

পুরো বছরেই বেশ উড়ছে পেপ গার্দিওলার ইংলিশ চ্যাম্পিয়ন দলটি। প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রিমিয়ার লিগে তারা সব ক্লাবকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে। আর্লিং হালান্ডের দুর্দান্ত ফর্মে ভর করে প্রতিপক্ষকে রীতিমত দুমড়ে দিয়েছে সিটিজেন্সরা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপের পর অধরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ উঠেছে তাদের হাতে। 

এরপর সুপার কাপ জিতে ইউরোপিয়ান চক্রটাও পূরণ হয়েছে। সবশেষ ডিসেম্বর মাসে ঘরে তুলেছে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপাটাও। সবমিলিয়ে বছরটা যেন ছিল পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির। 

জেএ