ঝুঁপড়ি ঘর থেকেই মায়ের হাতে বানানো প্লাস্টিকের বল খেলতে খেলতে বড় হয়েছেন ইয়ারজান। গোলরক্ষক হয়ে বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে একটি শিরোপাও এনে দিয়েছেন তিনি। গ্রামের মাঠ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছেন। নেপালে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালের ৯০ মিনিটেও যখন ১-১ গোলে ম্যাচ ড্র, এরপর টাইব্রেকারে ভারতের তিনটি শট ঠেকিয়ে দেশের শিরোপা নিশ্চিত করেন ইয়ারজান।

সে জয়ের আনন্দে এখনও মাতোয়ারা সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। ইয়ারজানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। আব্দুর রাজ্জাক ও রেনু বেগমের এই সন্তান অন্য আট-দশজন মেয়ের মতোই। গ্রামের অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জায়গা করে নেন বয়সভিত্তিক ফুটবল দলে।

দুই বোনের মধ্যে ইয়ারজানই বড়। ঘরে অসুস্থ বাবা, যার কারণে তিনি কাজ করতে পারেন না। ফলে একমাত্র উপার্জনক্ষম মা রেনু বেগমের আয়ে চলে তাদের সংসার। সম্পদ বলতে তাদের কেবল ভিটেমাটি। ঘর থাকলেও জরাজীর্ণ। ঘরে আসবাবপত্র না থাকলেও, ইয়ারজানের সাফল্যের ক্রেস্ট এবং ট্রফিতে সাজানো শোকেস পরিপূর্ণ। এমন পরিবার থেকে ইয়ারজানের ওঠে আসার গল্প দারুণ মর্মস্পর্শী।

সাফজয়ী দলের সতীর্থ ও কোচের সঙ্গে ইয়ারজান

ইয়ারজানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশের একজনের বাদাম ও টমেটো ক্ষেতে কাজ করছিলেন ইয়ারজানের মা রেনু বেগম। দিনশেষে ২৫০ টাকা শ্রমে মজুরী আসলেও সে টাকায় চলছে না দারিদ্র-পীড়িত টানাপোড়েনের সংসার। পাটখড়ির বেড়া দেওয়া বাড়িতে মাত্র তিনটি ছোট ঘর। একটিতে টিনশেড, আরেকটিতে ঘরের টিনের চাল ভেঙেছে। তার পূর্ব পাশের পলিথিনের ছাউনির ঘরটি রান্নার জায়গা। মেরামত করার টাকাও নেই। ফলে জরাজীর্ণ ঘরেই চলছে বসবাস। জীর্ণ এই কুটির থেকেই দুয়েক বেলা খেতে না পেরেও ফুটবল খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল গোলরক্ষক ইয়ারজান। খেলেছেন বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে গ্রামের মাঠে। 

কাজে ব্যস্ত মা রেনু বেগমের সঙ্গে ওই অবস্থাতেই কথা হয়। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে ইয়ারজানের বাবা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তিনি কাজ করতে না পারায় আমাকেই কামলা দিতে হয়। সারা দিন কাজ করে পাই ২৫০ টাকা। এই টাকায় চলে চারজনের সংসার। আমাদের কোন আবাদি জমিজমা নেই। আমার শ্বশুর ইয়ারজানের দাদা বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ উদ্দিন ২২ শতক জমি দিয়েছিলেন। এ জমিতে আবদুর রাজ্জাকসহ চার ভাইয়েরা বসবাস করছেন। মেয়ের এই জয়ে বুক বাধলেও এভাবেই চালানো সংসারে বাড়ির কোন পরিবেশ নেই।

ইয়ারজান কিভাবে খেলোয়াড় হয়ে উঠলেন, জানতে চাইলে রেনু বেগম বলেন, ‘শিশুকাল থেকেই আমার মেয়ের ফুটবল খেলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। ইয়ারজানের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর, ওই সময় দেখতাম সামনে কোন বল পেলে সেটা নিয়ে ছুটোছুটি করতো। আমাদের তো সামর্থ্য নাই, তাই পুরোনো পলিথিন দিয়ে বল বানিয়ে দিতাম মেয়েকে। সেটা নিয়েই আশপাশের শিশুদের নিয়ে খেলতো। ওর বাবা যখন ঢাকায় কাজ করতেন, তখন তাকে বলে দোকান থেকে একটি বল কিনে দিয়েছি। সেটা দিয়েই পরে স্কুলে ফুটবল খেলতে শুরু করে।’

ইয়ারজানের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মা রেনু বেগম

২০১৭ সালের দিকে হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর খেলা দেখে টুকু রেহমান (স্থানীয় একাডেমির পরিচালক) তাকে তার ফুটবল একাডেমিতে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু একাডেমিতে ভর্তি ও খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য ছিল না ইয়ারজানের পরিবারের। কিন্তু টুুকু রেহমানের উৎসাহে পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়ামে টুকু ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হয় ইয়ারজান। তবুও এত দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল তাদের। গ্রামের লোকজনও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। কিন্তু রেনু বেগমের মেয়ের জেদ ছিল ফুটবল খেলার। তাই সব বাঁকা চোখকে তোয়াক্কা না করে ফুটবল খেলে গেছেন। 

গত বছর উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগের ট্রায়ালে খেলতে ঢাকা গিয়েছিল ইয়ারজান। বাড়ি ফিরে মেয়ে বলল, মা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অফিসাররা আমাকে পছন্দ করছে। আমাকে খেলতে ডাকা হবে। তিন মাস আগে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ ফুটবলের ট্রায়াল হয়। ঢাকায় হওয়া সেই ট্রায়ালেও ইয়ারজানকে পাঠানো হয় টাকা ধার করে। ঢাকা থেকে নেপালে গিয়ে মেয়েটা ফুটবলে শিরোপা জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এমনটা ভাবেননি মা রেনু বেগম। বিজয়ের পর গ্রামের সেই বাঁকা চোখগুলোতেও আনন্দ দেখার কথা জানান তিনি। 

ইয়ারজানের বিজয়ের অনুভূতি জানিয়েছেন বাবা আব্দুর রাজ্জাকও, ‘আমি তো এমনিতে অসুস্থ। আমাদের কোন স্মার্টফোন নেই। যখন শুনলাম আমার মেয়ে গোল আটকিয়ে জিতেছে, তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। এত আনন্দ কখনও পাইনি। কখনও কল্পনাও করিনি এমন বিজয় দেখতে পারব। মেয়ে ফুটবল খেলছে, সে খেলবে এমনই ছিল ধারণা। সে যে এত বড় অর্জন করবে তা ভাবতে পারিনি।’

ইয়ারজানের অর্জিত পুরস্কারের একাংশ

মা রেনু বেগম সেই সুর টেনে বলেন, ‘মেয়ের বিজয়ের কথা শুনেই গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কি আনন্দ! তারা বাড়িতে এসে অনেক কিছু আয়োজন করল। খিঁচুড়ি রান্না হলো। সেদিন রাতে যখন ইয়ারজান ফোনে কথা বলল, বলল মা আমরা জিতে গেছি। তখন আনন্দে কেঁদেছি। মেয়ে দেশে ফিরে ফোন করে জানিয়েছে, দেশে ফিরেছে। গ্রামে ফিরবে ঈদের আগেই। মেয়ে ফিরলেই তাকে খুব ভালোভাবে খাওয়াব। এখন মেয়ের আসার অপেক্ষায় আছি সবাই।’

প্রশাসন থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ইয়ারজানের মা-বাবা বলেন, নেপালে ইয়ারজানদের খেলার শিরোপা জয়ের খবরের পর আমাদের বাড়িতে জেলা প্রশাসক স্যার, র‌্যাব ও চেয়ারম্যানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আসছেন। ডিসি স্যার, আমাগো ঘর দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। র‌্যাব আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন ইফতার ও নগদ টাকা।

টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ইয়ারজানের বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। আমি তাকে আমার ফুটবল একাডেমিতে নিয়ে আসি। কিন্তু তার বাড়ি থেকে আসতে অনেক কষ্ট হতো। তারপরেও সে নিজের অদম্য চেষ্টায় ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। নেপালের মাঠে ভারতের বিপক্ষে গোল আটকে শিরোপা জয়ের পাশাপাশি সেরা গোলরক্ষক হয়ে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ অর্জন আমার, আমার একাডেমিরও, পঞ্চগড়বাসীর। ইয়ারজান আমাদের গর্ব।

হাড়িভাসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইয়েদ নূর-ই-আলম জানিয়েছেন, গোলরক্ষক ইয়ারজান নেপালের ভারতের বিপক্ষে খেলে পেনাল্টিতে গোল আটকে শিরোপা অর্জন করায় আমরা খুবই আনন্দিত। জেলা প্রশাসক ইয়ারজানের বাড়ির ঘর ও টয়লেট নির্মাণে খরচের হিসান জানতে চেয়েছেন। আগামী বুধবারের মধ্যে এর একটা বাজেট দেব। আশা করছি দ্রুতই তাদেরকে ভালো ঘর করে দিতে পারব। 

একইভাবে পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম, সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ইয়ারজানের। ইয়ারজান আমাদের সন্তান, সে আমাদের পঞ্চগড়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার সাফল্যের কথা জেনে তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা সবসময় তার পরিবারের পাশে আছি।

এসকে দোয়েল/এএইচএস