দুয়ারে চলে এসেছে আরেকটা ইউরো। এইতো আর মাত্র ক’দিন পরেই পর্দা উঠবে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরের। ২৪ দলের এই লড়াইয়ের নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যবহুল লেখা আজ থেকে প্রকাশিত হবে ঢাকা পোস্টে। আজ থাকছে ‘এ’ গ্রুপ নিয়ে আলোচনা-

কার্যত ডেথ গ্রুপ হিসেবে পর্তুগাল, ফ্রান্স, জার্মানির ‘এফ’ গ্রুপকে ধরা হচ্ছে সেই গ্রুপ নির্ধারণের পর থেকেই। কিন্তু একটা গ্রুপে যখন র‍্যাঙ্কিংয়ের ৭, ১৩, ১৭ আর ২৯ নম্বর দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সেটাও তীব্র প্রতিযোগিতারই ইঙ্গিত দেয়। তেমন কিছু নিয়েই অপেক্ষা করছে ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ওয়েলস ও তুরস্ককে নিয়ে গড়া গ্রুপ-‘এ’।

ইতালি

গেল বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই নতুন করে সব শুরু করে ইতালি। রবার্তো মানচিনির অধীনে দলের পুনঃনির্মাণ কাজটা যে চলেছে দারুণভাবেই, তার ছাপ দলের পারফর্ম্যান্সেই স্পষ্ট। বাছাইপর্বে নিজেদের সবকটি ম্যাচে জয়, এরপর প্রীতি ম্যাচেও যথেষ্ট ধারাবাহিক ছিল আজ্জুরিরা। 
তবে বড় টুর্নামেন্ট সব দলের জন্যই সবসময় বড় পরীক্ষা। তাই ইতালির ধারাবাহিকতার জন্যও বড় এক পরীক্ষা হয়েই আসছে ইউরো ২০২১।
ইউরোয় সূচি- প্রতিপক্ষ তুরস্ক, ১১ জুন; প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড, ১৬ জুন; প্রতিপক্ষ ওয়েলস, ২০ জুন।

যেভাবে ইউরোয়- ‘জে’ গ্রুপ থেকে ১০ ম্যাচের সবকটা জিতে পূর্ণ ৩০ পয়েন্ট নিয়ে এবারের ইউরোয় এসেছে সাবেক শিরোপাজয়ী ইতালি। বাছাইপর্বে এমন কীর্তি গড়তে পেরেছে কেবল বেলজিয়ামই।

আগের ইউরোয় যেমন খেলেছে- কোয়ার্টার ফাইনাল

সেরা সাফল্য- চ্যাম্পিয়ন (১৯৬৮)

ফিফা র‍্যাঙ্কিং-

ডাগ আউটের সম্রাট- রবার্তো মানচিনি

চোখ রাখবেন যার ওপর-ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি। খেলেন সিরি’আর ক্লাব সাসুওলোতে। ইতালীয় ফুটবলে চোখ না থাকলে তাকে চেনার কথাও নয় আপনার। তবে তার অন্তর্ভুক্তিই চলতি মৌসুমে সাসুওলো মাঝমাঠে বেশ স্থিতি এনে দিয়েছে। বলের দখল, প্রেস রেজিস্ট্যান্সি আর দূরদর্শন দিয়ে আসছে ইউরোয় তিনি হয়ে যেতে পারেন ইতালির প্রাণভোমরাও।

শক্তিসামর্থ্য ও দুর্বলতা- আর সব বারের মতোই দলটার সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের রক্ষণ। বাছাইপর্বে ছয় ম্যাচে রেখেছিল ক্লিনশিট। এবারও জুভেন্তাস জুটি লিওনার্দো বনুচ্চি আর জর্জিও কিয়েলিনির সঙ্গে আটালান্টার রাফায়েল তোলোইকে নিয়ে গড়া রক্ষণকে ভাঙা কঠিনই হবে প্রতিপক্ষের জন্য। তবে আক্রমণভাগ এবার দলের প্রধান মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে, কিরো ইমোবিলেরা ক্লাবে যেমন ফলপ্রসু, তেমনটা জাতীয় দলে নন। সঙ্গে আছে আক্রমণকে কে নেতৃত্ব দেবেন, এ প্রশ্নটাও। সব মিলিয়ে আক্রমণ নিয়ে বড় একটা চিন্তা নিয়েই ইউরোয় পা রাখবেন ইতালি কোচ রবার্তো মানচিনি।

রক্ষণ তো বটেই, দলেরই নেতৃত্বের দায়িত্ব কিয়েলিনির কাধে/গেটিইমেজ

সম্ভাব্য একাদশ-
৩-৫-২ ছকে
ডনারুমা;
কিয়েলিনি, বনুচ্চি, তোলোই; 
এমারসন, লোকাতেল্লি, ভেরাত্তি, পেল্লেগ্রিনি, ফ্লোরেঞ্জি; 
ইনসিনিয়ে, ইমোবিলে।

সুইজারল্যান্ড

দারুণ কিছু খেলোয়াড় আছে দলে, যারা ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে বিবেচিত হন ক্লাবগুলোর মূল্যবান সম্পদ হিসেবেই। জাতীয় দলেও খেলেন দারুণ। সাধে তো আর ফিফা র‍্যাঙ্কিং ১৩ নয়। কিন্তু নক আউট এলেই যেন সিন্দাবাদের ভূত সওয়ার হয় দলটার ঘাড়ে। সেই ১৯৩৮ সাল থেকে কিনা নেই কোনো নকআউট জয়! সেই খরা এবার কাটানোর লক্ষ্যেই ইউরোয় এসেছে দলটা। 

ইউরোয় সূচি-প্রতিপক্ষ ওয়েলস, ১২ জুন; প্রতিপক্ষ ইতালি, ১৬ জুন; প্রতিপক্ষ তুরস্ক, ২০ জুন।

যেভাবে ইউরোয় এসেছে-‘ডি’ গ্রুপের শ্রেষ্ঠত্ব বাগিয়ে নিয়ে সুইজারল্যান্ড এসেছে এবারের ইউরোয়।

যেমন খেলেছে সর্বশেষ ইউরোয়-শেষ ১৬।

সেরা সাফল্য-২০১৬ (শেষ ষোল)।

ফিফা র‍্যাঙ্কিং-১৩

কোচ-ভ্লাদিমির পেতকোভিচ

মূল খেলোয়াড়-জেরদ্রান শাকিরি। ডাকনাম আলপাইন মেসি। লিওনেল মেসির মতো পায়ের কারুকাজ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের ত্রাতা বনে যাওয়ায় তার জুড়ি মেলা ভার। সঙ্গত কারণেই এবারের ইউরোয় চোখ রাখতে হবে তার ওপরেও।

জেরদ্রান শাকিরি/গেটিইমেজ

শক্তিসামর্থ্য ও দুর্বলতা-ফলাফল বের করে আনতে পারার দারুণ দক্ষতা কোচ পেতকোভিচের সুইজারল্যান্ডের গুণ। সঙ্গে ডেনমার্ক আর আয়ারল্যান্ডের গ্রুপ থেকে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ইউরোতে আসাটা দলটাকে দেবে বাড়তি মনোবল, যা কাজে লাগাতে পারলে গ্রুপ পর্ব উতরে যাওয়া তো বটেই, ১৯৩৮ সালের পর প্রথম নকআউট ম্যাচ জেতাও খুব সম্ভব দলটার জন্য।

তবে দলের বেঞ্চের দুর্বলতা কিছুটা পিছিয়েই দিতে পারে সুইসদের। কারণ একাদশের পর বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় খুব একটা নেই সুইজারল্যান্ডের। যা কিছুটা ভাবনাতেই রাখতে পারে কোচ পেতকোভিচকে।

সম্ভাব্য একাদশ-
৩-৪-৩ ছকে,
সমের;
এলভেদি-আকাঞ্জি-রদ্রিগেজ; 
উইডমার, ফ্রলার, শাকা, ভার্গাস; 
শাকিরি, সেফারোভিচ, এম্বোলো

ওয়েলস

ক্রিস কোলম্যান যা করেছিলেন ২০১৬ ইউরোয়, তা করা হয়তো কঠিন; কিন্তু সেই দলের মূল খেলোয়াড়রা এবারও আছেন দলটিতে, যা দারুণ এক প্রজন্ম তৈরি করেছে ওয়েলস দলে। গ্যারেথ বেলের তারকাখ্যাতি তাকে রাখবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে, তবে শেষ ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হ্যারি উইলসনের দারুণ দলীয় নৈপুণ্যের ছাপ রেখে করা গোলটা জানান দিচ্ছে, কেবল বেল নির্ভর দল নয় ওয়েলস। এবারের ইউরোর ‘এ’ গ্রুপে তাই চোখ রাখতে হবে এ দলটির ওপরেও।

ইউরোয় সূচি- প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড, ১২ জুন; প্রতিপক্ষ তুরস্ক, ১৬ জুন; প্রতিপক্ষ ইতালি, জুন ২০।

যেভাবে এসেছে মূল পর্বে- বাছাইপর্বের ই গ্রুপ থেকে রানার্স আপ হয়ে গ্যারেথ বেলের ওয়েলস এসেছে মূল পর্বে। শেষ দিনে দলটির ২-০ গোলের জয়ে বাছাইপর্বে কপাল পোড়ে স্লোভাকিয়ার।

যেমন খেলেছে শেষ ইউরোয়- সেমিফাইনাল

সেরা সাফল্য-২০১৬ সেমিফাইনাল

ফিফা র‍্যাঙ্কিং-১৭

ডাগ আউটের সম্রাট- রবার্ট পেজ

চোখ রাখবেন যার ওপর-গ্যারেথ বেল। ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা যখন আপনার দলে আছে, তখন নিশ্চিতভাবেই তার ওপর ভরসা রাখতেই হবে আপনাকে। ওয়েলসের হয়ে ৩৩ গোল করা এই ফরোয়ার্ডের সর্বশেষ মৌসুমটা অবশ্য ভালো কাটেনি, তবে টটেনহ্যামের হয়ে বাজে মৌসুমটাকে পেছনে ফেলতে ইউরোয় নিশ্চিতভাবেই মুখিয়ে থাকবেন তিনি। আরেকজনের ওপরও চোখ রাখতে পারেন, তিনি কেইফার মুর। কার্ডিফ সিটির হয়ে ক্যারিয়ারসেরা ২০ গোলের এক মৌসুম কাটিয়ে এসেছেন তিনি। ওয়েলসের হয়ে বাছাইতে দুই গোলে জানান দিচ্ছে, জাতীয় দলেও আলো কাড়তে প্রস্তুত তিনি।

গ্যারেথ বেল/গেটি ইমেজ

শক্তি ও দুর্বলতা- গেলবার সেরা সাফল্য দেখা দলটি এবারও তারুণ্যে ভরপুর। প্রতি আক্রমণে এ তারুণ্যের ছাপ দলটাকে করে তুলেছে বেশ সমীহজাগানিয়া। এবারও এই প্রতি আক্রমণই দলটাকে রাখবে হিসেবের খাতায় ওপরের দিকেই। তবে দলের দুই তারকা বেল আর অ্যারন র‍্যামসে নিজ নিজ ক্লাব দলে তেমন সময়ই পাননি। এ বিষয়টা কিছুটা হলেও ভাবনায় রাখতে পারে কোচ পেজকে।

সম্ভাব্য একাদশ-
৩-৪-৩ ছকে
ওয়ার্ড; 
রোডোন-লরেন্স-মেফ্যাম; 
উইলিয়ামস-আম্পাদু-অ্যালেন-রবার্টস; 
বেল-জেমস-উইলসন/মুর।

তুরস্ক

মহামারিকালটা শাপে বর হয়েই এসেছে তুরস্কের জন্য। গেল বছর এ সময়ে হলে মেরিহ দেমিরাল, ওজান কাবাক, ইউসুফ ইয়াজিসি কিংবা চেঙ্ক তোসুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু খেলোয়াড়কে পেতেন না কোচ সেনোল গুনেস। এবার এ অনুপস্থিতির তালিকায় আছে কেবল শেষ জনের নাম।
ইউরো বাছাইয়ে উতরে গেলেও নেশন্স লিগে সামগ্রিক ফলাফলটা তেমন ভালো হয়নি। ‘বি’ গ্রুপে দলটা জার্মানি আর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-৩ ড্র করেছিল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেই দেখুন না! ৪-২ গোলে হারিয়েছে নেদারল্যান্ডসকে, নরওয়েকে ৩-০ গোলে। সঙ্গে আবার আছে পুঁচকে লাটভিয়ার সঙ্গে ৩-৩ ড্রও। ফলে দলটা যে কোন ম্যাচে কী করবে, তা আগে থেকে বলে দিতে পারবেন না আপনি।

ইউরোয় সূচি- প্রতিপক্ষ ইতালি, জুন ১১; প্রতিপক্ষ ওয়েলশ, জুন ১৬; প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড, ২০ জুন।

যেভাবে ইউরোয়- বাছাইপর্বে গ্রুপ এইচের রানার্স আপ হয়ে মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে তুরস্ক। যে গ্রুপের সেরা দল হয়েছে ফ্রান্স, আর তুরস্কের উঠে আসায় কপাল পুড়েছে গেলবারের কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট আইসল্যান্ডের। 

আগের ইউরোয় যেমন খেলেছে- গ্রুপ পর্ব

সেরা সাফল্য-সেমিফাইনাল (২০০৮)

ফিফা র‍্যাঙ্কিং- ২৯

ডাগ আউটের সম্রাট - সেনোল গুনেস (তুরস্ক)

চোখ রাখবেন যার ওপর- বুরাক ইলমাজ। তুরস্কের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা শেষ কিছুদিন ধরেই আছেন দারুণ ছন্দে। গত মার্চে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে করেছেন হ্যাটট্রিক, তার ওপর ভর করেই তো পিএসজি থেকে লিগ ওয়ান শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে লিল! তার ওপর বড় ভরসা করেই যে ইউরোয় এসেছে, বিষয়টা ফুটে উঠেছে কোচ গুনেসের কথাতেই। সদ্যসমাপ্ত ঘরোয়া মৌসুমে ফরাসি লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ইলমাজের অন্তর্ভুক্তিই তুরস্ককে এই টুর্নামেন্টের ‘কালো ঘোড়া’ তকমা দিয়ে দিয়েছে।

ইলমাজে অনেকটাই নির্ভর করবে তুরস্ক/গেটি ইমেজ

শক্তি ও দুর্বলতা- দলটার রক্ষণ বাছাইপর্বে খেলেছে দুর্দান্ত। সেখানে সেরা রক্ষণাত্মক রেকর্ডটাও তাদেরই দখলে। ইউরোয় আসার পথে দশ ম্যাচের আটটাতেই গোল হজম করেনি দলটি। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে তুলে নিয়েছিল দুর্দান্ত একটা জয়ও। সে রক্ষণাত্মক পারফর্ম্যান্সটা ধরে রাখতে পারলে এবারের ইউরোতেও তুরস্কের বিপক্ষে গোল করতে ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা প্রতিপক্ষের। তবে দলটার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আবার এর ঠিক পরেই। সম্ভাব্য গোলরক্ষক উগুরকান চেকির বেশ অনভিজ্ঞ, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যা ভোগাতে পারে তুরস্ককে।

সম্ভাব্য একাদশ-
৪-৫-১ ছকে
চেকির; 
মেরাস-সয়ুইনচু-কাবাক-চেলিক; 
ইয়োকুসলু, তুফান, চালহানোগ্লু, আন্তালইয়ালি, উন্দের; 
ইলমাজ

এনইউ/এটি