ইউরোর বিল্ড আপ থেকেই বেশ বলাবলি হচ্ছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর নাকি এটা ‘শেষ’ ইউরো। ক্যারিয়ারজুড়ে যত আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছেন, তাতে ২০২৪ সালের ইউরোটাও তো খেলে ফেলতে পারেন! তবে সেটা যদি না হয়, এটাই হবে তার শেষ। পর্তুগালের হয়ে সম্ভাব্য শেষটা ইউরো দিয়ে রাঙাতে কি মুখিয়ে থাকবেন না জুভেন্তাস তারকা? 
থাকবেন হয়তো। কিন্তু গ্রুপ ‘এফ’ এ তার দল পড়ে গেছে ‘মৃত্যুকূপে’। সঙ্গে আছে কারা, শুনুন; ফ্রান্স, জার্মানি আর হাঙ্গেরি। পারফর্ম্যান্সে একটু এদিক ওদিক হলে থাকবে বিদায়ের শঙ্কা। না হলে গ্রুপ শ্রেষ্ঠত্ব হারানো, যেটা হলে নকআউটের শুরুতেই পড়তে হবে বড় প্রতিপক্ষের সামনে। রোনালদোর পর্তুগালের কাজটা তাই বেশ কঠিন। একই বিষয় প্রযোজ্য কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্স, কিংবা সাবেক বিশ্বকাপজয়ী জার্মানির ক্ষেত্রেও। ‘এফ’ গ্রুপে তাই বাড়তি নজর না দিয়েই পারবেন না আপনি!

পর্তুগাল
‘শেষ’ ইউরো খেলতে নামা রোনালদো আছেন। সেটা একটা উপলক্ষ আর বাড়তি অনুপ্রেরণা বটে, কিন্তু পর্তুগালের শিরোপার যোগ্যতম দাবিদার হওয়ার আরও অনেক কারণ আছে। দলের আক্রমণ থেকে শুরু করে রক্ষণ, প্রায় নিখুঁত কোচ ফের্নান্দো সান্তোসের দল। ফলে কঠিন গ্রুপ সত্বেও সেটা উতরে গিয়ে শিরোপার দারুণ দাবিদারই ধরা হচ্ছে পর্তুগালকে।

এক নজরে-
সূচি- প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরি, ১৫ জুন, প্রতিপক্ষ জার্মানি, ১৯ জুন; প্রতিপক্ষ ফ্রান্স; ২৩ জুন।
যেভাবে ইউরোয়- বাছাইপর্বে বি গ্রুপে ছিল সান্তোসের দল। সেখান থেকে রোনালদোরা মূল পর্বে এসেছেন সেরা দল হয়েই। 
সবশেষ ইউরোয়- চ্যাম্পিয়ন।
সেরা সাফল্য: চ্যাম্পিয়ন (২০১৬)।
ফিফা র‍্যাঙ্কিং-৫।
কোচ- ফের্নান্দো সান্তোস।

নজরে থাকবেন যিনি- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো থাকবেনই। ডিয়েগো জোটার ওপরও চোখ রাখুন। লিভারপুলের বাজে মৌসুমে দলকে জিতিয়েছেন অনেকগুলো ম্যাচ। সেই ফর্মটা নিশ্চয়ই ইংল্যান্ডে ফেলে আসবেন না তিনি। তাই তার ওপর বাড়তি নজর রাখতেই হবে আপনার।
শক্তি- স্কোয়াড গভীরতা। দলের আদ্যোপান্ত বেশ অভিজ্ঞ ও গুণমানসম্পন্ন খেলোয়াড়ে ঠাসা, যারা বেঞ্চ থেকে এসেই ঘুরিয়ে দিতে পারেন ম্যাচের মোড়। ফলে কোচ সান্তোসের হাতেও থাকবে বাড়তি বিকল্প।
দুর্বলতা- বদলে যাওয়া কৌশলে শেষ কিছু দিন ধরে দলকে খেলাচ্ছেন কোচ। ফলে রক্ষণভাগকেও খেলতে হচ্ছে হাইলাইন ধরে।  এই কৌশলে তাদের পেছনে ফেলে আসা স্পেস সাধারণত সামলাতে হয় গোলরক্ষককে। কিন্তু পর্তুগালের প্রধান গোলরক্ষক এতে কিছুটা কাঁচা। এক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলাতেই পড়তে হতে পারে পর্তুগালকে।

সম্ভাব্য একাদশ- 
৪-৩-৩ ছকে; 
লোপেজ;
মেন্দেজ, পেপে, ডিয়াজ, ক্যানসেলো; 
বের্নার্দো, সানচেজ, নেভেস;
ফেলিক্স, জোটা, রোনালদো।

ফ্রান্স
কোচ দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্সের ঝুলিতে শেষ চার বছরে আছে দুটো মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা। প্রথমবার যদিও এবারের গ্রুপসঙ্গী পর্তুগালের কাছে হেরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল দলের। তবে দ্বিতীয়বার আর হয়নি, তাও বিশ্বকাপে! সে থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই অধরা ইউরোটা এবার জিততে এসেছে ফরাসিরা। 

এক নজরে
সূচি- প্রতিপক্ষ জার্মানি, ১৫ জুন; প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরি, ১৯ জুন; প্রতিপক্ষ পর্তুগাল, ২৩ জুন।
যেভাবে ইউরোয়- ইউরো বাছাইপর্বের গ্রুপ ‘এইচ’ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘ল্য ব্লু’রা এসেছে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরে।
শেষ ইউরোয়- রানার্সআপ।
সেরা সাফল্য- চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৪ ও ২০০০)।
র‍্যাঙ্কিং- ২
কোচ- দিদিয়ের দেশম

চোখ রাখবেন যার ওপর- কিলিয়ান এমবাপে। তিন বছর আগে বিশ্বকাপে যখন এসেছেন, গা থেকে কৈশোরের গন্ধটা যায়নি তখনো। কিন্তু সেই বয়সেই কিনা, ‘ফ্রান্সের হয়ে জেতা’ নয়; ফ্রান্সকে জেতালেন বিশ্বকাপ! করে বসেছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল, পেলের পর দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে করেছিলেন এ কীর্তি!
এখন তো ইউরোপীয় ফুটবল আরও ঋদ্ধ করেছে তাকে, বক্সে এখন আগের চেয়েও ক্ষুরধার হয়েছেন। এই তো, মাস কয়েক আগে লিওনেল মেসির বার্সেলোনা, সর্বজয়ী বায়ার্নকে দিয়েছিলেন সর্বনেশে ছোবল, ছিটকে দিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে। সেবার পারলে এবার কেন নয়? আর তাই, এমবাপেতে বাড়তি নজর রাখতেই হবে আপনাকে।

শক্তিসামর্থ্য- সব জায়গাতেই দারুণ কিছু খেলোয়াড় আছে। তবে দলটায় আক্রমণভাগকে একটু এগিয়ে না রাখলেই নয়। আপনি ভাবুন একবার, আপনার মূল একাদশে আছেন কারিম বেনজেমা (যদি ফিট হয়ে ফিরে আসেন), অ্যান্টোয়ান গ্রিজমান, কিলিয়ান এমবাপেদের মতো ম্যাচ উইনার আছেন। তার ওপর বেঞ্চ থেকে নামবেন উসমান দেম্বেলে কিংবা কিংসলে কোম্যানরা, যারা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন চুটকিতেই। সব মিলিয়ে ফরাসিদের আক্রমণভাগকে তর্কসাপেক্ষে টুর্নামেন্টেরই সেরা বলে দেওয়া যায়। 

দুর্বলতা- খুব বেশি না হলেও ফরাসিদের রক্ষণ কিছুটা দুর্বল। রাফায়েল ভারান মৌসুমটা খুব ভালোভাবে পার করেননি, একই দশা প্রেসনেল কিমপেম্বেরও। মানসম্পন্ন আক্রমণের মুখে পড়লে কতটা রক্ষা করতে পারবেন ফরাসি গোলমুখকে তা নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যায়।

সম্ভাব্য একাদশ- 
৪-৩-৩ ছকে;
লরিস;
এর্নান্দেজ, কিমপেম্বে, ভারানে, পাভার্ড;
তোলিসো, কান্তে, পগবা; 
বেনজেমা, গ্রিজমান, এমবাপে।

জার্মানি
‘ফুটবলটা একটা খেলা, যা দুই দলের ২২ জন মিলে ৯০ মিনিট ধরে খেলে, আর দিনশেষে জেতে জার্মানি’-কথাটা বিদগ্ধ ফুটবল পণ্ডিত গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন। অতোটা না হলেও বাস্তবে জার্মানি মাঠে নামা মানেই ‘ডি মেনশ্যাফট’দের সেমিফাইনালে খেলা ছিল অনেকটা অবধারিত বিষয়। 
কিন্তু সে দিন এখন সুদূর অতীত। কোচ জোয়াকিম লোর অধীনে শেষ বিশ্বকাপে বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে, এরপর ইউরো বাছাই, নেশন্স লিগেও কাটিয়েছে কঠিন এক সময়। এবারের ইউরোর কিছুদিন আগেও স্পেনের কাছে হেরেছে ৬-১ গোলে। সব মিলিয়ে দারুণ কিছু পারফর্মার থাকলেও দলটা ভালো নেই, দলের রসায়ন ভালো নেই।
সেই দলটাই পড়েছে এবার গ্রুপ অফ ডেথে। ফলে দলটার শেষ ষোলয় যাওয়া নিয়েই একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে, শিরোপাজয় তো দূর অস্ত! তবে ঠিক আগে লাটভিয়ার বিপক্ষে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত মিলেছে দলটির। থমাস মুলার বলেছিলেন, নিজেরা যেভাবে খেলতে চান, ঠিক সেভাবেই খেলেছেন দলটি। সেটা যদি ইউরোতেও বজায় থাকে তাহলেই তো বর্তে যায় জার্মানরা! 

এক নজরে-
সূচি- প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, ১৫ জুন; প্রতিপক্ষ পর্তুগাল, ১৯ জুন; প্রতিপক্ষ হাঙ্গেরি, ২৩ জুন।
যেভাবে ইউরোয়- ‘সি’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
সবশেষ ইউরোয় যেমন খেলেছে- সেমিফাইনাল।
সেরা সাফল্য- চ্যাম্পিয়ন (১৯৭২, ১৯৮০ ও ১৯৯৬)।
ফিফা র‍্যাঙ্কিং- ১২।
কোচ- জোয়াকিম লো।

নজরে থাকবেন- জশুয়া কিমিখ। নুইয়ে পড়া জার্মানিকে যদি ঠিক পথে ফেরাতে হয় তাহলে সেটা কিমিখে নির্ভর অনেকটাই। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ হোক আর সেখানে ফিজিক্যালিটি যোগ করার ‘নোংরা কাজটা’ করা, কিমিখের জুড়ি মেলা ভার। বায়ার্ন মিউনিখ মিডফিল্ডার তাই লোর অনেক ভরসার একটা জায়গা হয়েই থাকবেন এই ইউরোয়।
শক্তি- বেঞ্চের শক্তি। জার্মানির প্রত্যেক পজিশনে রয়েছে দারুণ সব খেলোয়াড়। দলটার মাঝমাঠেই দেখুন, যদি গোরেৎস্কা, কিমিখ আর ক্রুসকে নিয়ে খেলা শুরু করে জার্মানরা, তবু দলটার বেঞ্চে বসে থাকবেন ইলকায় গুন্দোয়ান, ফ্লোরিয়ান নহাউসের মত মিডফিল্ডার। ফলে কোচ লোর কাছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবাইকে খেলানোর সুযোগ বিলাসিতাও থাকছে দারুণভাবেই।
দুর্বলতা- রক্ষণভাগ। আক্রমণ আর মাঝমাঠে যেমন রসদ দলটির, তেমন নাম নেই দলটির রক্ষণে। সঙ্গে যোগ করুন খোদ কোচ লো-কে। ফলে ২০১৮ বিশ্বকাপের বিভীষিকা আবারও ফিরে এলেও খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

সম্ভাব্য একাদশ-
৪-৩-৩ ছকে; 
ন্যয়ার; 
গোসেন্স, হামেলস, সুলে, ক্লস্টারমান;
ক্রুস, কিমিখ, গোরেৎস্কা;
ভের্নার, মুলার, গেনাব্রি।

হাঙ্গেরি
গেল আসরে পর্তুগালের গ্রুপেই ছিল হাঙ্গেরি। সেবার দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষমেশ ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে ৪৪ বছর পর ইউরোয় আসা দলটি। এবারও পর্তুগাল আছে গ্রুপে, আগেরবারের সেই ম্যাচ নিশ্চিতভাবেই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে দলটিতে। তবে গ্রুপে ফ্রান্স আর জার্মানির উপস্থিতি থাকায় হাঙ্গেরিয়ানদের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।

এক নজরে
সূচি: প্রতিপক্ষ পর্তুগাল, ১৫ জুন; প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, ১৯ জুন; প্রতিপক্ষ জার্মানি, ২৩ জুন।
যেভাবে ইউরোয়- প্লে অফ থেকে প্যাথ এ জিতে দলটা এসেছে মূল টুর্নামেন্টে।
শেষ ইউরোতে: শেষ ষোলো।
সেরা সাফল্য: তৃতীয় স্থান (১৯৬৪)।
ফিফা র‍্যাঙ্কিং- ৩৭
কোচ- মার্কো রসি

নজরে থাকবেন- সেন্টার ব্যাক উইলি অরবান হাঙ্গেরি দলের বেশ দারুণ এক সম্পদ। রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি প্রতিপক্ষ গোলমুখেও বাড়তি ত্রাস সৃষ্টি করতে পটু তিনি। বাছাইপর্বে তিন গোল করে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়াটা তারই সাক্ষ্য দেয়।
শক্তিসামর্থ্য- গোলরক্ষক গুলাশি আর সেন্টারব্যাক অরবান আরবি লাইপজিগে খেলেন একসঙ্গে। দু’জনের রসায়ন হাঙ্গেরি রক্ষণকে দেবে বাড়তি নির্ভরতা। আর নিজেদের মাঠ পুসকাস অ্যারেনায় সবক’টা ম্যাচ খেলবে দলটা। ফলে হোম অ্যাডভান্টেজটা তাদের এগিয়ে রাখবে ফ্রান্স, পর্তুগালের বিপক্ষে। 
দুর্বলতা- ফরোয়ার্ড সালাই আর অ্যাডাম শালাই আছেন গোলখরায়। নাহয় সেন্টারব্যাক অরবানকে কেন বাছাইপর্বে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে হবে? সেই ফরোয়ার্ডদের গোলখরা কাটেনি এখনো। সঙ্গে যখন যোগ হয় মৃতুকূপের বিষয়টা তখন হাঙ্গেরির আশা ক্ষীণ হয়ে আসে আরও।

সম্ভাব্য একাদশ: 
৩-৫-২ ছকে; 
গুলাশি; 
ফিওলা, ওরবান, আত্তিলা সালাই;
লভ্রেনসিক্স, ক্লেইনহেইসলার, ন্যাগি, গাজদাগ, ভার্গা;
সালাই, অ্যাডাম শালাই।

এনইউ