২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর। মেসিকে এর চেয়ে বেশি খুশি কবে দেখেছেন আপনি? গেটি ইমেজ

২০০৬ বিশ্বকাপের শুরু হয়নি তখনো। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ কাছে এলে যেমন হয়, রথী-মহারথীদের কাছে বাড়ে সাংবাদিকদের ভিড়, তাদের কাছেই নতুন রথী-মহারথীদের খোঁজও নেওয়া হয় দেদারসে।

ডিয়েগো ম্যারাডোনাও এ থেকে ব্যতিক্রম নন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অন্যদের চেয়ে কয়েক কাঠি সরেসও। তার কাছেও জানতে চাওয়া হলো, আর্জেন্টিনা দলের ‘নতুন ম্যারাডোনা’ কে? আলবিসেলেস্তে শিবিরে তখন এমনিতেই ‘নতুন ম্যারাডোনা’দের অভাব নেই। পুরনো ‘নতুন ম্যারাডোনা’ হুয়ান রোমান রিকেলমে ছিলেন, যোগ হয়েছিলেন হ্যাভিয়ার স্যাভিওলা, পাবলো আইমার আর কার্লোস তেভেজও। ম্যারাডোনা তাতে যোগ করলেন নতুন এক নাম; সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলে দিলেন একটাই নাম বললেন, ‘লিওনেল মেসি’।

তারপর থেকেই জল্পনা-কল্পনা। ম্যারাডোনার মুখ থেকে ‘নতুন ম্যারাডোনা’ তকমা পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!

চোটের কারণে সে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে খেলতে পারলেন না। পরের ম্যাচেও ছিল শঙ্কা। সব কাটিয়ে কোচ হোসে প্যাকারম্যানের কাছ থেকে পেলেন মোটে ১৫ মিনিট; চোট কাটানো, সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণের জন্য তো অভিষেকে সে সময়টা বেশি কিছুই। মেসি এলেন, কার্লোস তেভেজকে দিয়ে করালেন এক গোল, পরে নিজেও নামটা লেখালেন গোলের খাতায়। অভিষেকে, চোট পেরিয়ে এসেই ১৯ বছর বয়সী তরুণের এমন পারফর্ম্যান্স; ব্যস, আসলেই ‘নতুন ম্যারাডোনার’ সাক্ষাৎ পেয়ে গেল বিশ্ব।

সেই বসনিয়া হার্জেগোভিনা ম্যাচে, যেদিন শুনিয়েছিলেন আগমনী বার্তা/গেটি ইমেজ

এর ঠিক দশ মাস পর, পরের বছরের এপ্রিলে যা করলেন, তাতে ম্যারাডোনা-প্যারানয়া আরও বেশি মাথাচাড়া না দিয়েই পারে না। মাঠের মধ্যম রেখা থেকে বলটা পেলেন জাভির কাছ থেকে, এরপর একে একে গতি, ক্লোজ কন্ট্রোল আর ড্রিবল দিয়ে ছিটকে দিলেন ৮ জন গেটাফে ডিফেন্ডারকে। বিপদসীমায় গিয়ে গোলরক্ষককে পেলেন, তাকেও কাটিয়ে গেলেন দারুণ স্টেপওভারে, এরপর অবধারিত গোলটা আদায় করলেন।  

এ তো গেল তার গোল অফ দ্য সেঞ্চুরির পুনর্মঞ্চায়ন। ম্যারাডোনা হতে হলে ‘ঐশ্বরিক হাতের’ খেল না দেখালে কি হয়? সেটাও ফেরালেন মাসকয়েক পরে, হাত দিয়ে গোল করে! ম্যারাডোনার মতো ছোটখাটো গড়নের, আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির মতোই খেলার ধরণ, তার সঙ্গে যখন যোগ হয় এমন সব কীর্তি-অকীর্তি, নতুন ম্যারাডোনার অভাব ফুরোল বলে, এই ভ্রম প্রত্যেক আর্জেন্টাইনের মনে হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। হলোও।

____

আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে, থেটিস ছিলেন সাগরপরী। গ্রীক পুরাণ বলে তার বিয়েটা হয়েছিল রাজা পেলেউসের সঙ্গে। তাদের কোল আলো করেই জন্ম হয় মহাবীর অ্যাকিলিসের।

জন্মের পরই বাধল বিপত্তি। ভাগ্যদেবীরা বললেন, এই ছেলে হয় নিরুত্তাপ দীর্ঘ জীবন লাভ করবে, নাহয় অকালেই মারা পড়বে ট্রয়ের যুদ্ধে গিয়ে। মায়ের মন, শেষটার প্রমাদই গুনলেন থেটিস। হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরোলেন, কোন বরে শেষটা থেকে বাঁচাতে পারা যায় ছেলে অ্যাকিলিসকে।

*

আমাদের গল্পের নায়ক, লিওনেল মেসির জন্মের পরই অবশ্য মা সেলিয়া মারিয়া কুচিত্তিনিকে কেউ বলে দেননি তেমন কিছু। বললেন আরও কয়েক বছর পর। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে ধরা পড়ল, মেসির গায়ে আছে দুর্লভ ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম’, যা হলে দেহের বৃদ্ধি থমকে যায়। করাতে হবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, নাহয় প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে আর পা রাখা হবে না পুঁচকে মেসির।

*

খুঁজলে নাকি ঈশ্বরের সাক্ষাৎও পাওয়া চলে। থেটিসও পেয়ে গেলেন।

এক ভাগ্যদেবীর কাছে জানলেন, যদি অ্যাকিলিসকে ডোবানো যায় স্বর্গ-মর্ত্যের সীমানায় বয়ে চলা স্টিক্স নদী, যাকে দেবতারাও মানেন দারুণ পবিত্র জলাধার, তার জলে, তবেই মিলবে মুক্তি। আর কোনো জরা ছুঁতে পারবে না অ্যাকিলিসকে।

ছোট্ট অ্যাকিলিসকে নিয়ে মা থেটিস ছুটলেন সেই স্টিক্স নদীতে। ছেলের পুরো শরীর ডুবিয়ে দিলেন সেখানে, একটা জায়গা বাদে। অ্যাকিলিসের গোড়ালি তিনি ধরে রেখেছিলেন ফলে পুরো শরীর রক্ষাব্যুহে ঢুকে পড়লেও তার গোড়ালি থেকে গিয়েছিল অরক্ষিত।

*

মেসির জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল সেই ডাক্তারের কথাতেই। সেই রোগ ধরা পরার কিছুদিন পরেই বার্সেলোনার চোখে পড়লেন তিনি। পেপার ন্যাপকিনে সই নিয়ে তাকে তুলে আনা হলো কাতালুনিয়ায়। চিকিৎসা হলো, সেরেও উঠলেন। তবে সেজন্যে একটা ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। সেই যে আর্জেন্টিনা ছাড়লেন লিওনেল মেসি, আর ‘ফেরা’ হয়নি রোজারিও, আর্জেন্টিনাতে। যে আক্ষেপ, যে শূন্যতা এখনো ভাবায় তাকে।

*

ইউটিউবে আজকাল হরহামেশা ভিডিওর দেখা মেলে, তারকা-মহাতারকার ‘মোনটাজ’ এর। দেখলেই আপনার মনে হতে পারে, তার অপ্রাপ্তি বদলে বুঝি আর কিছু নেই! অ্যাকিলিসের পরের গল্পটা তেমন ‘প্রায়’ পূর্ণাঙ্গতার। যুদ্ধবিদ্যা শিখলেন, অদম্য অহংকার আর ক্রোধাবেগ দিয়ে যুদ্ধে নামার আগেই পেলেন দিগ্বিজয়ীর পরিচিতি।

সর্বজয়ের নেশা ছিল তার। সে নেশাই তাকে টেনে নিয়ে গেল ট্রয়ের যুদ্ধে। মায়ের শত কৌশল, শত বাধা উপেক্ষা করেই। শেষমেশ যখন গেলেন, মা থেটিস তাকে পরিয়ে দিলেন হেফেস্টাসের বানানো স্বর্গীয় অস্ত্র, বর্ম ও ঢাল; তাকে সাজালেন রণসাজে।

মহাবীর অ্যাকিলিসের জয়যাত্রা চলেছে সেখানেও। ট্রয়ের সেরা বীর হেক্টরকে মুখোমুখি লড়াইয়ে পরাস্ত করেন তিনি।

এতকিছুর পরেও তার রক্ষা মেলেনি। ওই যে, স্টাইক্স নদীর পানি ছুঁতে পারেনি তার পা, সেই অরক্ষিত অংশেই আসে আঘাত। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের ছোঁড়া তির বিঁধে সেই পায়ে, তাতেই প্রাণ যায় তার।
 
*

যে বার্সেলোনার অবদানে সেরে উঠলেন অদ্ভুত রোগটা থেকে, সেই ক্লাবটাকে দিলেন দু’হাত ভরে। তার আগের আর পরের ইতিহাস দেখলেই ঠাহর করা চলে, ক্লাবে কি বিশাল গুরুত্বই না তার! তার আগে ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ১টা, তিনি থাকা কালে দল জিতেছে চারটা, চারটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে আশাভঙ্গ না হলে সংখ্যাটা বাড়তেও পারতো। 

চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা নিয়ে/ফাইল ছবি

লিগ শেষ ১১ বছরেই জিতেছে ৮টা, কোপা দেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপের তো ইয়ত্তা নেই। সব মিলে তার সময়ে বার্সা জিতেছে ৩৫টি শিরোপা। তার আগে যেখানে বার্সেলোনার ট্রফি কেসে ছিল মাত্র ৫৫টা শিরোপা, তার ক্যারিয়ারের ১৭ বছরে সংখ্যাটা ছুঁয়েছে নার্ভাস নাইন্টিজ।

ব্যক্তিগত ট্রফির তো ইয়ত্তাই নেই। ছয়বার হয়েছেন বিশ্বসেরা ফুটবলারই, আরও ছয়বার ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলো মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। ভেঙেছেন অগুণতি রেকর্ড। এক বছরে ৯১ গোলের পাগলাটে রেকর্ডও জ্বলজ্বলে তার হিসেবের খেরোখাতায়।

কিন্তু একটা জায়গা বরাবরই তাকে ফিরিয়েছে খালি হাতে। যেই আর্জেন্টিনাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন ১৩ বছর বয়সে সেই আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদারঙা জার্সিটা।

এ যেন কিছুটা অ্যাকিলিসের পায়ের মতোই। অ্যাকিলিসের পা টা ডোবানো যায়নি স্টিক্সের জলে, মেসির রোগটা সারেনি আর্জেন্টিনায়। তখন থেকেই যেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশটা ফিরিয়েছে তাকে রিক্ত হাতে, ফেরাচ্ছে এখনো। হয়ে আছে অভিশাপ মতো।

চির অধরা সেই শিরোপা/গেটি ইমেজ

২০১৪ বিশ্বকাপে ক্যারিয়ার সেরা জাতীয় দলের পারফর্ম্যান্স দিয়েছেন। দলকে টেনে তুলেছেন ফাইনালে। সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ে যেন এ অভিশাপ সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চড়ে বসলো তার কাঁধে। নাহয় বলুন, ম্যাচের ৪৭ মিনিটে লুকাস বিলিয়া যে বলটা বাড়িয়েছিলেন তাকে তেমন জায়গা থেকে ক্যারিয়ারে কম করে হলেও আরও ৫০টা গোল করেছেন। সে জায়গা থেকে কী করে তার শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়? কেন তার সতীর্থ গনজালো হিগুয়াইন করে বসেন শিশুসুলভ মিস, কেন রদ্রিগো পালাসিওর শট যায় না জালে?

বিশ্বকাপ নাহয় হয়নি, কোপা তো হবে, নাকি? সেটাও হলো না! তার বাড়ানো বলে এসকিয়েল লাভেজ্জি হয়ে যখন সহজ ট্যাপ ইনের সুযোগ গেল সেই হিগুয়াইনের পায়ে, সেটা কী করে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়? পরের বছর ক্ষুরধার পারফর্ম্যান্স দিয়ে আবারও দলকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। এবারও সেই চিলি, এবারও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা। তবে এবার ষোলকলা পূরণ করলেন নিজে পেনাল্টি মিস করে।

ডিয়েগো ম্যারাডোনার মুখে ‘নতুন ম্যারাডোনা’ আখ্যা পেয়েছিলেন, তবে আসল ম্যারাডোনা আর হওয়া হয়নি তার। আলবিসেলেস্তেদের একটাও শিরোপা তিনি জেতাতে পারেননি, পারেননি এর আগে পরেও।

এত সব না পাওয়ার গল্প কেবল সেই তিন বছরেই। এর আগে-পরের ইতিহাস ধরলে তো মহাকাব্যই রচে দেওয়া যায় চাইলে।

____

আজ ২৪ জুন। লিওনেল মেসি পূরণ করেছেন ৩৪ বছর, পা দিয়েছেন ৩৫-এ। এর বছরের এই সময়টায় জন্মদিন বলে তার থাকা হয় জাতীয় দলের সঙ্গেই, বিশ্বকাপ কোপা মিলিয়ে এ সময় খেলেছেন নয়টা টুর্নামেন্ট।

তথ্যটা ধরিয়ে দিলে হয়তো আশ্চর্য হবেন, এই জন্মদিনের আগের আর পরের পারফর্ম্যান্সে তার পার্থক্যটা যেন আকাশ আর পাতালের। বিশ্বকাপ আর কোপায় তার আইকনিক (অতি অবশ্যই ইতিবাচক) মুহূর্ত ভাবুন তো, ২৪ জুনের পরের কিছু মনে করতে পারছেন? সেই বসনিয়া হার্জেগোভিনার বিপক্ষে দীর্ঘ খরা কাটানো গোল, সার্বিয়ার বিপক্ষে আগমনী বার্তা দেওয়া পারফর্ম্যান্সটা, ইরানের বিপক্ষে ‘কার্যত অসম্ভব’ গোলটা, কিংবা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সেই ফ্রি কিকটা? সবই তো সেই ২৪ জুনের আগের!

আট বছরের খরা কাটানো সেই গোলটার পর/ফাইল ছবি

আজ আরেকটা ২৪ জুন। আরেকটা ‘লিওনেল মেসি দিবস’। এবার কোপা আমেরিকায় সাময়িক ঝলক কিছু দেখিয়েছেন বটে, কিন্তু যা দিয়ে ফুটবলের সব হিসেব, সেই গোল-অ্যাসিস্ট করেছেন মোটে একটা করে। জন্মদিনের পর চোখরাঙাচ্ছে সে ‘অভিশাপও’। অ্যাকিলিসের পা হয়ে যাওয়া জাতীয় দলের পারফর্ম্যান্স তো আছেই।

তবে এতক্ষণ যা পড়ে এসেছেন, যেসব গল্প ফাঁদা হয়েছে, সবই কুতর্ক হয়ে যেতে পারে, যদি কেবল একটা শিরোপা ধরা দেয় লিওনেল মেসির হাতে। সব সমালোচনাও থেমে যাবে তাতে, হয়তো অমরত্বের মাপকাঠিতেও এগিয়ে যাবেন আরও একটু। সব ‘অভিশাপ’ এক পাশে রেখে, সব চোখরাঙানি আটলান্টিকে ভাসিয়ে, লিওনেল মেসি কি পারবেন, আর্জেন্টিনার হয়ে একটা শিরোপা জিততে? সেটা হয়ে গেলে যে প্রয়াত ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেওয়া আখ্যাটাও যে যথার্থতা পেয়ে যায়!

এনইউ/এটি