আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস বদলে দেওয়ার তিন বছর
একটি ফুটবল ম্যাচ কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে, না ফুটবল ম্যাচ নয়- বিশ্বকাপ ফাইনাল! এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের সেই ম্যাচটির গল্প, যেখানে পরতে পরতে ছিল উত্তেজনা। কতশত নাটক আর শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত তৈরি করে সেদিন ফুটবল জাদুকরের রঙিন পালকে ভরা শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটের একমাত্র ফাঁকা জায়গাটি পূরণ হয়েছিল। কাতারের দোহায় লুসাইল স্টেডিয়ামে সেদিন বদলে গিয়েছিল আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস।
১৯৮৬ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হাত’ ধরে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি এসেছিল আর্জেন্টিনার ঘরে। তারপর বিশ্বমঞ্চে শুধু আফসোসের গল্প। লিওনেল মেসির মাঝে ম্যারাডোনার ছায়া দেখা গেলেও পারেননি আক্ষেপ ঘুচাতে। ২০১৪ সালে হাতছোঁয়া দূরত্ব থেকে জার্মানির কাছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনার শোক। পরের আসরও শেষ হয় হতাশা নিয়ে। ২০২২ বিশ্বকাপে আবারো পুরোনো স্বপ্ন পূরণ ও শিরোপা জয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আর্জেন্টিনা অংশ নিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু শুরুতেই সৌদি আরবের কাছে ধাক্কা। বিশ্বকাপের বয়স দুই দিন হতেই প্রথম অঘটনের শিকার আর্জেন্টিনা। সৌদি আরবের ইতিহাস গড়া জয় সেদিন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল আলবিসেলেস্তেদের। একে একে মেক্সিকো, পোল্যান্ডকে গ্রুপ পর্বে নাকানিচুবানি খাইয়ে নকআউট পর্বের টিকিট কাটে। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ঘটনাবহুল ম্যাচ জিতে নিশ্চিত করে সেমিফাইনাল। লুকা মদরিচের ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনা। তাদের সামনে উড়তে থাকা ফ্রান্স।
বিজ্ঞাপন
লুসাইলে ১৮ ডিসেম্বরের রাত শুরুতেই স্মরণীয় করে রাখার বন্দোবস্ত করল আর্জেন্টিনা। ৩৬ মিনিটের মধ্যে তাদের লিড মেসি ও অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার গোলে। ৭৯ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে তারা। নাটক পরের মিনিট থেকে শুরু। নিকোলাস ওতামেন্দি ডিবক্সের মধ্যে ফাউল করলেন, পেনাল্টি থেকে কিলিয়ান এমবাপে ব্যবধান কমালেন। পরের মিনিটে পিএসজি সতীর্থ মেসির মুখ কালো করে দিলেন বক্সের বাইরে থেকে আরেকটি লক্ষ্যভেদী শটে।
যোগ করা সময়ে এমবাপে ও আদ্রিয়েন র্যাবিওটের শট অল্পের জন্য গোল হয়নি। অতিরিক্ত সময়ের খেলা। ১০৮ মিনিটে লাউতারো মার্তিনেজের ডানপাশ থেকে নেওয়া শট ফিরে আসে ফ্রান্সের গোলকিপারের গায়ে লেগে, ঠিক সামনেই ছিলেন মেসি। ডান পায়ে বল ঠেলে দেন জালে। আট মিনিট পর আবারো আর্জেন্টিনা পিছিয়ে পড়ে তাদের খেলোয়াড়ের ভুলে। বক্সের মধ্যে গঞ্জালো মন্তিয়েলের হ্যান্ডবলে পেনাল্টি থেকে স্কোর ৩-৩ করেন এমবাপে।
ফ্রান্স যতই অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের আভাস দিক, এদিন ফুটবল ঈশ্বর ছিলেন মেসিদের পাশেই। তিনি কলকাঠি নেড়েছেন তেকাঠির নিচে দাঁড়ানো এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে দিয়ে। নয়তো ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার মিনিটখানেক আগে র্যান্ডাল কোলো মুয়ানি এমন গোল কীভাবে না করে থাকতে পারেন! মাঝমাঠ থেকে সতীর্থের ক্রসের গতিপথ বুঝে বক্সে ঢুকে ডান ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড। তারপর ডানপায়ের ভলি, কীভাবে যে মার্তিনেজ বাঁ পা ছড়িয়ে বলটা ঠেকালেন, তা মনোবিজ্ঞানকেও হার মানাবে।
পরের গল্পটা সবার জানা। মুয়ানির শট অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়ে ম্যাচ টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেন মার্তিনেজ। সেভ অব দ্য সেঞ্চুরি-র সেই আত্মবিশ্বাস কাজে লাগালেন পেনাল্টি শুটআউটে। তার জাদুকরী গ্লাভস প্রথম শটে এমবাপেকে রুখতে না পারলেও ফ্রান্সের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা থামিয়ে দেন আর্জেন্টাইন কিপার। একের পর এক জালে বল পাঠিয়ে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। চতুর্থ শট নিতে আসেন মন্তিয়েল। ফ্রান্সের তৃতীয় গোলে হ্যান্ডবল দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করার দায় ছিল তার। বুকভরা শ্বাস নিলেন, তারপর ডানপায়ের শটে জাল কাঁপিয়ে জার্সি খুলে মুখ ঢাকলেন। ক্যামেরা যেন খুঁজে ফিরছিল, মেসি কী করেন। সতীর্থদের আলিঙ্গনে সিক্ত তিনি। মাঠের চার দিকে ততক্ষণে আবেগঘন এক পরিস্থিতি।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপ, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে হারের দুঃখ ঘুচে গেল আর্জেন্টিনার। ৩৬ বছরের আক্ষেপের অবসান। বদলে গেল আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস। সেই ইতিহাস বদলানো দিনের তিন বছর পূর্ণ হলো গতকাল। আগামী বছরের ১৮ ডিসেম্বর হয়তো আবার আর্জেন্টিনা এই দিনটি পালন করবে, কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব ধরে রাখতে পারলে সেই উদযাপনটা হবে ভিন্ন মাত্রার। সেই লক্ষ্যেই আগামী বিশ্বকাপে অংশ নিবে আর্জেন্টিনা, মেসি নামবেন নতুন উদ্যোম সঙ্গে করে।
এফএইচএম/