ইউরোপিয়ান ফুটবলে চমক, দেম্বেলের শ্রেষ্ঠত্বের বছর
শেষ হতে চলেছে ২০২৫, এই বছর বিশ্ব ফুটবলে চমক দেখিয়েছে পিএসজি, টটেনহ্যামের মতো দলগুলো। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দেখা গেছে ছোট দেশের ঝলক। বছরের শেষ দিকে লিওনেল মেসি আমেরিকায় তার অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদে কিলিয়ান এমবাপে ছুঁয়েছেন তার আইডলকে। তবে ব্যক্তিগতভাবে নজর কেড়েছেন উসমান দেম্বেলে, বছরটা নিজের করে নিয়েছেন দলীয় ও ব্যক্তিগত পুরস্কার দিয়ে। তো ফিরে দেখা যাক, বিশ্ব ফুটবলে কেমন ছিল এই বছর-
ইউরোপে পিএসজি চ্যাম্পিয়ন
বিজ্ঞাপন
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে চমক দেখায় তারকাহীন প্যারিস সেন্ট জার্মেই। পাঁচ বছর আগের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন পূরণ করল তারা লিওনেল মেসি, নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো বড় তারকাদের ছাড়া। তরুণ একটি দল নিয়ে পিএসজি এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চ্যাম্পিয়ন। তিনবারের ইউরোপ জয়ী ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবার এই শিরোপা জিতল তারা। ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে এটি সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। ১৯৯৩ সালে মার্শেইর পর দ্বিতীয় ফরাসি ক্লাব হিসেবে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হলো পিএসজি।
২০১৫ সালে বার্সার পর কোচ লুইস এনরিকে ট্রেবল জিতলেন ফরাসি চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে। লিগ ওয়ান ও ফরাসি কাপের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি জিতে পেপ গার্দিওলাকে ছোঁন তিনি। দ্বিতীয় কোচ হিসেবে ভিন্ন দুটি ক্লাবের সঙ্গে ট্রেবল জয়ের কীর্তি গড়েন এনরিকে।
বিজ্ঞাপন
১৭ বছর পর টটেনহ্যামের ঘরে ট্রফি
ইউরোপা লিগে বেশ কিছু দারুণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ফাইনালে উঠেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তাদের চরম হতাশাজনক মৌসুমের মাঝে এক চিলতে আনন্দের উপলক্ষ হতে পারতো এই ট্রফি। শিরোপার লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ দল টটেনহাম হটস্পারও লিগে হতাশ করেছে। শেষ পর্যন্ত লিগ প্রতিপক্ষকে হারিয়ে তারা হেসেছে শেষ হাসি। রুবেন আমোরিমের ম্যানইউর আশাভঙ্গ করে ইউরোপা লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টটেনহাম। ১৭ বছরে প্রথম কোনও শিরোপা জিতেছে স্পাররা।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরের এই ট্রফি জিতে উচ্ছ্বাসে ভেসেছে টটেনহাম। সান সেবাস্তিয়ানে ১-০ গোলে তারা ফাইনাল জিতেছে। এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে আগামী চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলো প্রিমিয়ার লিগে রেলিগেশন অঞ্চলের ঠিক এক ধাপ উপরে ১৭ নম্বরে থাকা স্পাররা।
২০০৮ সালে লিগ কাপের পর এটি টটেনহামের প্রথম শিরোপা এবং ১৯৮৪ সালের পর প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি। টটেনহামকে ইউরোপা লিগ জিতিয়ে ১৭ বছরের ট্রফি খরা ঘুচানোর ১৬ দিন পর কোচ আগনে পোস্তেকোগলু বরখাস্ত হন।
পর্তুগালের স্মরণীয় বছর
এই বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে আলোচনায় ছিল পর্তুগাল। ২-২ গোলে ড্রয়ের পর উয়েফা নেশনস লিগের ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে স্পেনকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন তারা। ফাইনালে গোল করে ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন অধিনায়ক ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরো ও অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটসাল ইউরোতেও চ্যাম্পিয়ন হয় দেশটি। বছরের শেষটাতেও তারা সাফল্য পেয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে জিতেছিল তারা। যে কোনো পর্যায়ে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল।
পর্তুগালের জার্সিতে রোনালদোর প্রথম লাল কার্ড
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হারের ম্যাচে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে প্রথমে হলুদ কার্ড দেখেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পরে ভিএআর সেটি বদলে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম লাল কার্ড দেখায় তাকে। ২২৬তম আন্তর্জাতিক ম্যাচে এসে প্রথমবার লাল কার্ড দেখেন পর্তুগিজ অধিনায়ক।
ইতালির বিশ্বকাপ ঝুঁকিতে
বিশ্বকাপে একসময় দাপট দেখিয়ে বেড়ানো ইতালি টানা তৃতীয়বার দর্শক হয়ে থাকার ঝুঁকিতে। ইউরোপিয়ান অঞ্চলের বাছাইয়ের শেষ রাউন্ডে নরওয়ের কাছে হেরে আবার প্লে অফ পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
গ্রুপে ইসরায়েল, এস্তোনিয়া ও মলদোভাকে হারালেও প্রথম ও শেষ রাউন্ডে নরওয়ের কাছে হার কাল হয়ে দাঁড়াল ইতালির জন্য। গত দুইবারের মতো এবারো প্লে অফে খেলতে হবে ইতালিকে। আগামী ২৬ মার্চ প্লে অফে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে খেলবে তারা।
২৮ বছর পর নরওয়ের ফেরা, হালান্ডের রেকর্ড
১৯৯৮ সালে শেষবার বিশ্বকাপে খেলেছিল নরওয়ে। বাছাইয়ের শেষ রাউন্ডে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ২৮ বছর পর আবারো বিশ্বমঞ্চে তারা।
ক্লাব কিংবা জাতীয় দল- দুই জার্সিতে এবার অদম্য আর্লিং হালান্ড। বাছাইয়ের এক আসরে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছুঁলেন তিনি। ৮ ম্যাচে নরওয়ের ৩৭ গোলের মধ্যে তার গোল ১৬টি। ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সর্বোচ্চ ১৬ গোল করেছিলেন পোল্যান্ডের রবার্ট লেভানডোভস্কি।
কুরাসাও, কেপ ভার্দে ও হাইতির চমক
ইতিহাস গড়ল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কুরাসাও। সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিলো মাত্র দেড় লাখ জনসংখ্যার দেশটি। ৪৪৪ বর্গকিলোমিটার দেশটির জনসংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার। বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ এটিই। বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে ফুটবল বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিয়ে ভেঙে দিল আইসল্যান্ডের রেকর্ডও।
নিকারাগুয়াকে ২–০ গোলে হারিয়ে ১৯৭৪ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে ফিরছে হাইতি। আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কেপ ভার্দে। বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে কেপ ভার্দে ইতিহাস গড়ে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইংল্যান্ডের ইতিহাস
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইতিহাস গড়েছে ইংল্যান্ড। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে (অন্তত ৬ ম্যাচ খেলেছে এমন) শতভাগ জয় এবং গোল হজম না করার রেকর্ড তাদের। এর আগে কেবল চারটি ইউরোপীয় দেশ বাছাইপর্বে শতভাগ জয় নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে। তবে গোল হজম করেছে তাদের প্রত্যেকেই। ৮ ম্যাচে ২২ গোল করেছে থ্রি লায়নরা।
ক্লাব বিশ্বকাপ ও কনফারেন্স লিগে চেলসির দাপট
বড় পরিসরের ক্লাব বিশ্বকাপে ফেভারিট দল ছিল বেশ কয়েকটি। রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মায়ামির মতো দলগুলোকে হারিয়ে ফাইনালের আগে সেই তকমা ভালোভাবে নিজেদের করে নিয়েছিল প্যারিস সেন্ট জার্মেই। সেমিফাইনালে মাদ্রিদ ক্লাবকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া ফরাসি চ্যাম্পিয়নরা শিরোপার লড়াইয়ে পায় চেলসিকে, যারা অনেকটা চমক দেখিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ফাইনালে ওঠে। চমকের শেষ হলো ফাইনালের একমাত্র ফেভারিট পিএসজিকে হারিয়ে। নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ১০ জনের ফরাসি চ্যাম্পিয়নদের ৩-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব চেলসি।
চেলসি পঞ্চম ও ইংল্যান্ডের প্রথম দল হিসেবে একাধিক ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ের তালিকায় রিয়াল মাদ্রিদ (৬), বার্সেলোনা (৩), বায়ার্ন মিউনিখ (২) ও করিন্থিয়ান্সের (২) সঙ্গে যোগ দিয়েছে। চার বছর আগে ২০২১ সালের ফাইনালে পালমেইরাসকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্লুরা। তার আগে মে মাসে রিয়ার বেতিসকে ফাইনালে হারিয়ে উয়েফা কনফারেন্স লিগে শিরোপা জিতেছিল চেলসি।
উসমান দেম্বেলের বছর
একসময় ব্যালন ডি’অর মানেই ছিল লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর রাজত্ব। তবে এখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে তারা। ব্যালন ডি’অরের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও ছিলেন না দুজন। আলোচনা বেশি ছিল লামিনে ইয়ামাল আর উসমান দেম্বেলেকে নিয়ে। লড়াইটাও দুজনের মাঝেই হয়েছে বেশি। যেখানে ইয়ামালকে হারিয়ে ব্যালন ডি’অর জিতেছেন দেম্বেলে।
প্যারিসে জমকালো অনুষ্ঠানে দেম্বেলের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফরাসি সাময়িকী ‘ফ্রান্স ফুটবল’- এর পুরস্কার, ব্যালন ডি’অর ২০২৫। প্রথমবারের মতো বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারটি জিতলেন ২৮ বছর বয়সী এ ফুটবলার। ষষ্ঠ ফরাসি ফুটবলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েছেন পিএসজি ফরোয়ার্ড।
গত মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলে ৫৩ ম্যাচ খেলে ৩৫ গোল করেছিলেন দেম্বেলে। তার দারুণ পারফরম্যান্সে ৩২ দলের প্রথম ক্লাব বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেছিল ফরাসি জায়ান্টরা। যদিও চেলসির কাছে হাতছাড়া হয় শিরোপা। এমন দারুণ পারফরম্যান্স দিয়ে দেম্বেলে তার জাতীয় দলের সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপে ও স্পেনের তারকা লামিনে ইয়ামালকে হারিয়ে ফিফারও বর্ষসেরা হয়েছেন।
বিশ্বকাপ ড্র
ওয়াশিংটন ডিসির জন এফ কেনেডি সেন্টারে বিশ্বকাপ ড্রয়ের দিন আলোচিত হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেওয়া প্রথম ফিফা পিস প্রাইজ। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর বিরুদ্ধে নীতিমালা লংঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই ড্র শেষে আর্জেন্টিনা গ্রুপে পেয়েছে আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া ও জর্ডানকে। ব্রাজিলের গ্রুপ প্রতিপক্ষ মরক্কো, হাইতি ও স্কটল্যান্ড।
এমবাপের রেকর্ড
কিলিয়ান এমবাপে এই বছরও রিয়াল মাদ্রিদে দারুণ ফর্মে। ২৭তম জন্মদিন স্মরণীয় করে রাখতে মাঠে নামলেন, গোল করলেন, দলকে জেতালেন এবং ছুঁলেন নিজের আইডলের রেকর্ড! সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেভিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে রিয়াল মাদ্রিদকে জিতিয়ে শীর্ষে থাকা বার্সেলোনার কাছে নিলেন ফরাসি ফরোয়ার্ড। আর এক পঞ্জিকা বর্ষে রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে ভাগ বসালেন।
এদিন পেনাল্টি থেকে লিগের চলতি আসরে ১৮তম গোল করেন এমবাপে। ২০১৩ সালে এক পঞ্জিকা বর্ষে মাদ্রিদ ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৯ গোল করেছিলেন পর্তুগিজ উইঙ্গার। সেভিয়ার বিপক্ষে জালে বল জড়িয়ে সেই রেকর্ড ছুঁলেন এমবাপে।
মায়ামিতে মেসির শিরোপা
যে উদ্দেশ্যে লিওনেল মেসিকে এনেছিল ইন্টার মায়ামি, তা পূরণ হয়েছে। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডকে নিয়ে ২০২৩ সালে লিগস কাপ ও ২০২৪ সালে সাপোর্টার্স শিল্ড জিতেছে তারা। কিন্তু অধরা থেকে গেছে এমএলএস কাপ। বছরের শেষ দিকে সেই লক্ষ্যও পূরণ হলো। প্রথমবার মেসি মায়ামিকে জেতালেন এমএলএস কাপ, নিজের ক্যারিয়ারের রেকর্ড ৪৭তম ট্রফিও হাতে নিলেন আটবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী। এই বছরও টানা দ্বিতীয়বার এমএলএস-এর মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার হয়েছেন তিনি, পেয়েছেন মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।
এফএইচএম/