জাভেদ প্যাটেল, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার

কয়েক ঘণ্টা পরই অর্থাৎ রোববার রাতে ইংল্যান্ড ও ইতালির ইউরো কাপ ফাইনাল। ১৯৬৬ সালে নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। ৫৫ বছর পর বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে ইংল্যান্ড।

ইংল্যান্ডবাসীরা তাই স্লোগান দিচ্ছে ‘ইটস কামিং হোম।’ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কোপার ফাইনালের মধ্যেও ইউরোপের দুই পরাশক্তি ইংল্যান্ড ও ইতালির ফাইনালও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার জাভেদ প্যাটেল ইউরো কাপ, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কথা বললেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে।

প্রশ্ন: আপনাকে অভিনন্দন। সেমিফাইনালে ব্রিটিশ হাইকমিশন ও ডেনমার্ক দূতাবাসের যৌথ ভিডিও বার্তায় আপনার প্রেডিকশন একেবারে পুরোপুরি মিলে গেছে। 

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: ধন্যবাদ। আসলে এই প্রথম এত বড় খেলা নিয়ে আমি কোনো প্রেডিকশন দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত স্কোরলাইন পর্যন্ত মিলে গেল। বিষয়টি দারুণই লেগেছে।

প্রশ্ন: ১৯৬৬ সালের পর আবার ওয়েম্বলিতে ফাইনাল। ইউরোর ফাইনাল নিয়ে কতটুকু আশাবাদী এবং আরেকটি বড় ফাইনালের জন্য ৫৫ বছর অপেক্ষা কেন?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: দেখুন, ফুটবলপ্রেমী জাতি হিসেবে আমাদের অপেক্ষাটা অনেক দিনের হয়েছে। এটা সত্যি। আসলে এই ৫৫ বছরের অধীর অপেক্ষা জাতীয় পুরুষ দলের ফুটবলের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে হলেও নারী ক্রীড়া দল, জাতীয় ক্রিকেট সহ অন্যান্য খেলায় শিরোপা জেতা ও ফাইনাল খেলার দিক থেকে ইংল্যান্ড এগিয়ে আছে। তবে ৫৫ বছরের এই অপেক্ষা না করতে হলে অবশ্যই আরো ভালো হতো। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমাদের নিজ দেশের মাঠ ওয়েম্বলিতে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অতিমারীর প্রভাবে গত ১৬টি মাস আমাদের সবার জন্য খুবই কঠিন সময় ছিল। ফুটবল পুনরায় আমাদের সবাইকে ও ইংল্যান্ডবাসীকে একসাথে আনন্দঘন উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। আমি এবারের ইংল্যান্ড টিম নিয়েও ভীষণ গর্বিত। এই পর্যন্ত টুর্নামেন্টের তাঁরা দারুন খেলেছে! ওয়েম্বলির ফাইনালে আমরা জেতার ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী।

প্রশ্ন: সেমিফাইনালের মতো ফাইনাল নিয়ে যদি একটু প্রেডিকশন করতেন।

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: ফাইনাল নিয়ে আমার মাঝে অনেক উত্তেজনা কাজ করছে, কিন্তু একই সাথে আমি নার্ভাস। ইতালিও অনেক ভালো দল। তারা এই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলছে। তবে ইংল্যান্ডও অসাধারণ এবং একই সাথে তরুণ একটি দল। আমাদের দলে রহিম স্টার্লিং ও বোকায়ও সাকার মতো তরুণ ফুটবলার রয়েছে। এর প্রভাব ফাইনালের গোল স্কোরে অবশ্যই পড়বে। তবে যতগুলো গোলই হোক, আমার মনে হয় এই টুর্নামেন্টের কথা সবাই মনে রাখবে। ফাইনাল নিয়ে আমার প্রেডিকশন ইংল্যান্ড ১-০ ইতালি।

প্রশ্ন: ইউরোর সঙ্গে কোপাও চলেছে। অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞ বলছেন কোপা গুণে-মানে এবং জনপ্রিয়তায় ইউরোর চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। আপনি কি এর সাথে একমত?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশানর: বাংলাদেশে ইউরোপীয়ান ফুটবলের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ড দলের পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তারকা ফুটবলারদের অনেক সমর্থক বাংলাদেশে। এমনকি বাংলাদেশের অনেকেই এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখতে অসম্ভব ভালবাসেন। নিঃসন্দেহে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটবলপ্রেমীদের বিশেষ আকর্ষণের জায়গা ইউরোপের জাতীয় দল ও ক্লাব ম্যাচগুলো। তবে আমি জানি বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো অসাধারণ দুটি দলের অনেক অনেক বেশি সমর্থক রয়েছে। ফুটবল যতদিন থাকবে এই দল দুটির আবেদন সমানভাবেই থাকবে। কোপা ও ইউরো দুই টুর্নামেন্টের দুই রকম মর্যাদা ও গুরুত্ব। দুটি টুর্নামেন্ট তাদের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলছে। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশেও ফুটবলপ্রেমী অনেক। কোপা ও ইউরো নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনা কেমন দেখছেন ?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: লকডাউনের জন্য তো বের হওয়ার সুযোগ নেই। সামাজিক মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফুটবল নিয়ে প্রচুর আগ্রহ, উন্মাদনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখছি। ইউরো ও কোপা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের রিপোর্টও পড়ছি। খেলাধুলা মানুষের মাঝে এক অনন্য ঐক্যের বন্ধন তৈরি করে, একই সাথে আমাদের সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিক্ষাও প্রদান করে। এই অতিমারীর সময় ইউরো কিংবা কোপার সবার মাঝে যে আনন্দ ও আশার সঞ্চার করছে তা এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজনীয়। আশা করি ফুটবল নিয়ে এই আগ্রহ ও উন্মাদনা বজায় থাকুক। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফুটবল অনুসরণ করেন কি?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: আমি অত্যন্ত ফুটবল অনুরাগী। ১৬ মাস আগে কূটনেতিকের দায়িত্ব পালন করতে যখন এদেশে আসি তখন ভেবেছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় দলের ফুটবল খেলা মাঠে গিয়ে দেখব। কিন্তু অতিমারীর কারণে তা সম্ভব হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ আসবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে ব্রিটিশ কোচিং স্টাফ। জাতীয় দলের হেড কোচ জেমি ডে আর্সেনাল সমর্থক। যতটুকু জানি আপনিও অন্তঃপ্রাণ আর্সেনাল সমর্থক। বাংলাদেশে আর্সেনালের বড় সমর্থকগোষ্ঠী আছে। এদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: জেমি ডে’র সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে, এবং আমরা একই সাথে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, জেমি ডে’র গাইডেন্সে বাংলাদেশ জাতীয় ফুলবল দল ক্রমান্বয়ে ভালো খেলছে। আমি আর্সেনাল এর বিশাল ভক্ত! আমার বেড়ে ওঠা লন্ডনেই এবং ছোটবেলা থেকেই আর্সেনাল সমর্থক। বাংলাদেশের আর্সেনাল সমর্থকদের উদ্দেশে এটিই বলব- আর্সেনালের সঙ্গেই থাকুন, আর্সেনাল খুব শীঘ্রই সাফল্যে ফিরবে।

প্রশ্ন: অতি সম্প্রতি ইউরোপীয়ান সুপার লিগ নিয়ে ফুটবল বিশ্ব তোলপাড় ছিল। আপনার প্রিয় ক্লাব আর্সেনালও ছিল এতে। একজন আর্সেনাল সমর্থক হিসেবে ইউরোপীয়ান সুপার লিগ নিয়ে আপনার মতামত কি?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: বিষয়টি নিয়ে অনেক গুঞ্জন ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন এটি আত্নপ্রকাশ হলো এবং আমার প্রিয় ক্লাব আর্সেনালও ছিল এতে, তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। ফুটবল এখন শুধু খেলা নয়, এর সাথে বাণিজ্য,শিল্প, অর্থনীতি অনেক কিছু জড়িত। এরপরও ফুটবলের সৌন্দর্য্য হচ্ছে ছোট দলগুলো বড় দলগুলোর সাথে পয়েন্ট পাওয়া। ফুটবলের মৌলিক ধারণা ও স্পিরিটের সঙ্গে সুপার লিগ কোনোভাবেই যায় না। ফুটবলে সমর্থকরা বড় প্রাণ। সেই সমর্থকদের প্রতি আমার প্রিয় ক্লাব আর্সেনাল সমর্থন রেখে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় খুব খুশি হয়েছি। 

প্রশ্ন: ‘ক্রীড়া’ কূটনীতির অন্যতম এক মাধ্যম। আপনি একজন কূটনৈতিক হিসেবে খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো উন্নয়ন ও জোরদারের ক্ষেত্র কেমন দেখেন?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: ক্রীড়া অবশ্যই সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মত-বিভেদ থাকতেই পারে। তবে দিন শেষে আমাদের মাঝে খেলাধূলা আন্তরিকতা, সৌহার্দ ও ঐক্যের সঞ্চার করে। বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীদের দেখে আমি বেশ আলোড়িত বোধ করি। বিশেষ করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সময়। দারুণ বিষয় হচ্ছে, একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা চৌধুরী প্রিমিয়ার লিগে খেলছে। যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিরা প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত, বাংলাদেশেও দিন দিন এর সমর্থক বাড়ছে।

প্রশ্ন: গত কয়েক বছর ব্রেক্সিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইস্যু ছিল ইংল্যান্ডের জন্য। বেক্সিট হওয়ার পর ফুটবলে এর প্রভাব কেমন দেখছেন?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: সন্দেহাতীতভাবে ব্রেক্সিট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে ফুটবলের সাথে ব্রেক্সিট কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। আমরা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে না থাকলেও ফুটবল যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয়ান সব দেশের মানুষের আগ্রহের ও ভালোবাসার জায়গা। ফুটবলে ব্রেক্সিটের কোন প্রভাব নেই।

প্রশ্ন: আপনি মূলত ফুটবলপ্রেমী। ক্রিকেট কেমন দেখেন?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: আমার প্রথম ও প্রধান পছন্দ ফুটবল। তবে ক্রিকেটেও দেখি। বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে খোঁজ রাখি। সাকিব ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলে। তার অনেকের খেলা দেখি। 

প্রশ্ন: ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল... 

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: আমি জানি এবং খেলাও দেখেছি! আমি ভাবছিলাম আপনি এই প্রসঙ্গে আসবেন (হাসি )। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ হয়েছিল। আমি স্টেডিয়ামে গিয়ে ম্যাচও দেখেছি। ফুটবলের মতো ক্রিকেটেও ইচ্ছে আছে বাংলাদেশ ম্যাচ স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখার। 

প্রশ্ন: এক বছরের বেশি সময় আছেন। কেমন লাগছে বাংলাদেশ?

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: আমি গত বছর ফেব্রুয়ারির শেষে এসেছি। মার্চের পর থেকেই বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ। লকডাউনের মধ্যে অনেক সময় কেটেছে। এর মধ্যেও পেশাগত কাজে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বাংলাদেশে আমি খুব ভালো আছি এবং বেশ উপভোগ করছি। 

প্রশ্ন: ঢাকা পোস্টকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার: আপনাকে ও ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ। খেলাধুলার জন্য বিশেষ করে ফুটবলের জন্য আমি সব সময় পাশে আছি। 

এজেড/এটি/টিআইএস