চারপাশ লোকারণ্য, মাঝখানে মেসি। পিএসজি সমর্থকরা মহাতারকা বরণ করে নিয়েছে এভাবেই/রয়টার্স

গুঞ্জন তখনো বাস্তবতায় রূপ পায়নি, সেই তখন থেকেই পার্ক দেস প্রিন্সেসের আশপাশ রীতিমতো লোকারণ্য। এরপর অনানুষ্ঠানিকভাবে জানা গেল তিনি আসছেন, তিনি এলেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও এল। লিওনেল মেসি তখন থেকেই প্যারিসের, প্যারিস সেইন্ট জার্মেইঁয়ের।

'ছবির দেশে, কবিতার দেশে' যখন নামলেন তখন দেখা মিলল এক অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের। এক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব একটা দেশে পা রেখেছেন, সেখানে নেমেই দেখলেন তাকে পথ দেখিয়ে নিতে রীতিমতো বিশাল এক গাড়ির বহর। পার্ক দেস প্রিন্সেসের আশপাশ থেকে লোকারণ্য তখনো হালকা হয়নি, বরং সময়ের সাথে সাথে বেড়েছেই। এমন দৃশ্য ঢাকার রাস্তায় কেবল ভিভিআইপির আগমনেই হয়তো দেখে থাকেন আপনি, সেটাই পিএসজি করে দেখিয়েছে মেসিকে দলে ভেড়ানোর সময়।

ঘোষণাটা যখন এল, তখন ঘটে গেল আরও এক অবাক করা ঘটনা। পিএসজির অফিসিয়াল স্টোরে ছিল প্রায় পাঁচ লাখের মতো মেসির ৩০ নম্বর অঙ্কিত জার্সি, যার অর্ধেক ছিল অনলাইনের জন্য বরাদ্দ। স্বাভাবিকের চেয়েও পঞ্চাশ ইউরো বেশি হাঁকা হচ্ছিল দাম। তাতেও সমর্থকদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি আদৌ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ৩০ মিনিট না পেরোতেই অনলাইন স্টোর থেকে সব জার্সি হাওয়া! পিএসজির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেন উঠছে ফুলে-ফেঁপে। কাল থেকে এখন পর্যন্ত পিএসজির ইনস্টাগ্রাম অনুসরণই বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাকি সব কিছুকে না হয় হিসেবের বাইরেই রাখা যাক।

পরদিন, মানে আজ ধকলটা যাচ্ছে অফিসিয়াল স্টোরের ওপর দিয়ে। জার্সির জন্যে, মার্চেন্ডাইজের জন্যে সকাল থেকেই ভিড় ক্লাব কমপ্লেক্সের সামনে। আর স্টেডিয়ামের বাইরে? সেখানে ভিড় কমেছে কখন? 

বাংলাদেশ সময় বিকেল তিনটায় আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ক্লাব সভাপতি নাসের আল-খেলাইফি মেসিকে এলেন। তার অনেক আগে থেকেই পিএসজির উগ্রবাদী সমর্থক দল আল্ট্রাসরাসহ আবালবৃদ্ধবনিতা এসে হাজির হয়েছে স্টেডিয়ামে ঢোকার মূল ফটকের সামনে। চলছে অধীর অপেক্ষা, কখন আসবেন মহানায়ক? জবাব দেবেন তাদের অভিবাদনের?

মেসি তখনো সংবাদ সম্মেলনে। জানাচ্ছেন নিজের, পিএসজির স্বপ্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার ইচ্ছে, বন্ধু নেইমারের সঙ্গে খেলতে পারার রোমাঞ্চ আর পরিবার নিয়ে নতুন শহরে আসার সুখানুভূতির কথা। সব কথা শেষ হলো। পার্ক দেস প্রিন্সেসের সবুজ গালিচায় হলো হলো আরও একটা ফটোসেশন, ক্যামেরার শাটারের শব্দ হলো আরও ভারী, যা শুরু হয়েছিল সেই সংবাদ সম্মেলনের গোড়া থেকেই।

এরপরই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সমর্থকরাই তো খেলার প্রাণ, সেই সমর্থকদের অভিবাদনের জবাব দিতে মেসি এলেন স্টেডিয়ামের বাইরে। লাখের কাছাকাছি, কিংবা তারও বেশি মানুষের চিৎকার, করতালিতে সেখানে তখন কান পাতা দায়!

করোনা মহামারি চলছে। না হয় হয়তো ভরা স্টেডিয়ামেই হতো তার উপস্থাপন। স্টেডিয়ামের বাইরে আসার ‘আনুষ্ঠানিকতা’ সারতে হতো না আদৌ। তবে এই করোনাকাল থাকা সত্বেও যা হয়েছে তাতেই যেন মেসি ফিরিয়ে এনেছেন স্বদেশি কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। 

এমনিতে প্রয়াত ম্যারাডোনার সঙ্গে যেন তার মিলের শেষ নেই। আর্জেন্টাইন, বাম পায়ে খেলেন, খেলার ধরনও মিলে যায় বেশ, ডিয়েগো নিজেই এককালে তার উত্তরসূরি বলে গিয়েছিলেন মেসিকে, দু’জনে আবার খেলেছেন বার্সেলোনাতেও। সবশেষ দু’জনের মিলের খাতাতে যোগ হয়েছিল আরও একটা ‘ফ্যাক্ট’, বার্সার সঙ্গে বিচ্ছেদ।

এবার পার্ক দেস প্রিন্সেসে আরও একবার ম্যারাডোনাকে ফেরালেন মেসি। বার্সেলোনা এমনিতেই অনেক নায়কের ডেরা। সেই ডেরা ছেড়ে ১৯৮৪ সালে ম্যারাডোনা যখন ন্যাপোলিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে সত্তর হাজারের কিছু বেশি দর্শক বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁকে; পরিস্থিতি ছিল এমন নেপলসে যেন চাঁদ এসেছিল নেমে! 

বার্সেলোনায় এবার মেসিই ছিলেন সবচেয়ে বড় তারকা, সেটা গোটা ফুটবল বিশ্বেরও কি? তাই পিএসজির আয়োজনেও থাকল বাড়তি সব আয়োজন। তাদের ইতিহাসের সবচাইতে বড় ‘বাড়াবাড়ি’। যেমন বাড়াবাড়ি কেবল ন্যাপোলিই করতে পেরেছিল।

পিএসজির ইতিহাসে তারকার অভাব নেই। ইব্রা, রোনালদিনহো, বেকহ্যাম থেকে শুরু করে হালের নেইমার-এমবাপে; কিন্তু কোনো তারকাকে দলে ভেড়াতেই যেন আয়োজনে এভাবে সব্বাইকে ছাড়িয়ে যায়নি পিএসজি। মহাতারকাকে দলে ভেড়ানোর কেতাটাই যে ভিন্ন হতে হয়!

এনইউ/এটি