সাড়ে ১২ হাজার বর্গফুটের একটি খেলার মাঠ। সেখানেই চলে অনুশীলন। এই ছোট্ট মাঠেই প্রশিক্ষণ নেন অজপাড়াগাঁয়ের হত-দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা। যাদের কারও বাবা ভ্যান চালক, কারও বাবা ভূমিহীন কৃষক। এসব মেয়েরাই এখন দেশসেরা জেলা দলের সদস্য।

এ বছর জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল (মহিলা) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাগুরা জেলা দল। ফাইনালে যে ১২ জন ফুটবলার মাঠে নামেন। তাদের ১০ জনই এক স্কুলের ছাত্রী। এদের সবার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার একেবারে শেষ সীমান্তে গোয়ালদা ও তার আশেপাশের গ্রামে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় জেএফএ (জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২১ এর ফাইনাল। ম্যাচে ২-০ গোলে রাজশাহী জেলা দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার শিরোপা অর্জন করে মাগুরা জেলা দল। আর এই দলের ১২ জন খেলোয়াড়ের ১০ জনই মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চর-গোয়ালদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থী। এদের প্রশিক্ষক ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতি।

সরেজমিনে চর-গোয়ালদা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েরা ফুটবল খেলা অনুশীলন করছে। ওয়ার্মআপের পরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত করছে। আর তাদের সাথে মাঠে নেমে ফুটবল খেলার বিভিন্ন ধরনের কৌশল শেখাচ্ছেন তাদেরই প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতি।

সফলতার গল্প জানিয়ে জ্যোতি ঢাকা পোষ্টকে বলেন, ‘২০১৪ সালে হঠাৎ করেই মাথায় আসে বতর্মান সরকার যেহেতু নারীর ক্ষমাতায়নের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাহলে স্কুল শেষে বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি মেয়েদের একটি ফুটবল টিম গঠন করব। সে অনুযায়ী ছাত্রীদের অভিবাবকদের সঙ্গে কথা বলি। তখন সবাই আমার কথায় রাজি হয়ে যান। এরপর থেকেই প্রতিদিন স্কুল শেষে বিদ্যালয়ের এই ছোট্র মাঠেই তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘এরপর ছাত্রীদের নিষ্ঠা, কঠোর অনুশীলন আর একাগ্রতার কারণে আমার দল মাগুরা জেলা দল হিসেবে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নবম গেমস্-এ অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া জেএফএ ( জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২০ এবং ২০২১-এ অংশ নিয়ে আমরা দুইবারই চ্যাম্পিয়ন হই।’

জ্যোতি আরও বলেন, ‘যে মেয়েরা আজ দেশসেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি ও কৃতিত্ব অর্জন করেছে তাদের সবার বাড়ি এই গ্রাম এলাকায়। আর এদের প্রত্যেকেই হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এরা পছন্দসই ভালো মানের খাবারও খেতে পরে না। এদের কারো বাবা ভ্যান চালক, কারো বাবা ভূমিহীন কৃষক আবার কারো বাবা দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালায়।’

সারাদিন স্কুলে পড়িয়ে কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই প্রতিদিন এইসব মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। আমরা দুইজন এই এলাকার সন্তান। তাই এখানের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি মানসম্মত ও ভালো খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন এলাকার সুনাম বৃদ্ধি পাবে। তেমনি এদের দরিদ্র বাবা-মাও একদিন সুখের মুখ দেখবেন।’

অনুশীলন শেষে চর-গোয়ালদা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হয় এবারের জেএফএ-ফাইনাল খেলায় সবোর্চ্চ গোলদাতা বৃষ্টির সাথে। তিনি ঢাকা পোষ্টকে বলেন, ‘আমি প্রভাষ স্যারের ছাত্রী। ছয় বছর ধরে স্যারের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমি এখন পাশ্ববর্তী মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ৫ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭ গোল দিতে পারায় আমি অনেক খুশি।’

অনুভূতি জানতে চাইলে গোলদাতা বৃষ্টির বাবা প্রশান্ত মন্ডল বলেন, ‘আমার মনির ঠিকমতো খাবার-পড়বার দিতি পারিনে। আমার মনি যে গোল করিচে, তার জন্যি আমার খুব আনন্দ। প্রভাষ স্যার, এইসব মায়েগের (মেয়েদের) জন্যি যা করতিচে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’

ফাইনাল খেলায় অংশ নেওয়া এবরের মাগুরা জেলা দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাস বলেন, ‘প্রতিদিন স্কুল শেষে প্রভাষ স্যার বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের এই মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। এক প্রশ্নের জবাবে অর্পিতা বলেন, আমি বর্তমানে বিকেএসপি’র সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী।’

শ্রীপুর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার রবিউল ইসলাম এই মেয়েদের নিয়ে বলেন, ‘ফাইনালে জয় লাভ করে আমাদের উপজেলার সাধারণ মেয়েরা সারা জেলার মুখ উজ্জল করেছে।’

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) লিউজা-উজ-জান্নাহ এই ফুটবল দলের প্রশিক্ষক শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতিকে কৃতঙ্গতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের সংবর্ধনা দিতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করছি। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় খেলোয়াড়দের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় ১ লাখ টাকা আর বিভাগীয় কমিশনার মহোদয় ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন।’

মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম ঢাকা পোষ্টকে বলেন, জেলা দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি গর্বিত। এইসব মেয়েদের প্রয়োজন অনুসারে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া হবে। ভবিয্যতে তাদের একটি ফান্ড করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না ভাবছি।

একেএম/এমএইচ