চেলসিতে যোগ দিয়ে প্রথম দিনেই অনুশীলনে টুখেল /ছবি: চেলসি

ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের ছেড়ে যাওয়া পদটা অবশেষে জার্মান কোচ থমাস টুখেলকে দিয়েই পূরণ করেছে ইংলিশ পরাশক্তি চেলসি। নেইমারদের পিএসজির সাবেক কোচ ইউরোপীয় ফুটবলে যেমন পরিচিতি পেয়েছেন কৌশলগত দূরদর্শিতা ও পদ্ধতিগত চিন্তা দিয়ে, তেমনি অখ্যাতি আছে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা বোর্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়া নিয়েও। ক্লাব হিসেবে চেলসি নিশ্চিতভাবে প্রথমটাই যে চাইবে, তা বলাই বাহুল্য!  

পিএসজিকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার পর ফরাসি ক্লাবটিতে টুখেলের শেষটা মোটেও ভালো হয়নি। ক্রীড়া ব্যবস্থাপক লিওনার্দোর সঙ্গে ঝামেলা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। চাকরিচ্যুতির পেছনে শেষমেশ কাজ করেছে একটা সাক্ষাতকার, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘পিএসজির কোচ হওয়া কোনো দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীর হওয়ার চেয়ে কম ঝামেলার নয়।’ এরপরই পিএসজি-অধ্যায় শেষ হয় তার।

ফরাসি গণমাধ্যমে কানাঘুষা আছে যে, টুখেল নেইমার-এমবাপেকে নিয়ে গড়া পিএসজির তারকাখচিত দল নিয়েও খুব বেশি কিছু করতে পারেননি। তবে প্যারিসে তার ট্র্যাক রেকর্ড ভিন্ন কথাই বলছে। ফরাসি দলটাকে ঘরোয়া লিগে একরকম অদম্য করে তুলেছিলেন, জিতিয়েছিলেন টানা ঘরোয়া শিরোপা। ইউরোপে ভালো করতে না পারার অপবাদটাও ঘুচিয়েছিলেন গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজিকে ফাইনালে তুলে। সেদিন এমবাপে-নেইমাররা সুযোগ নষ্টের উৎসবে মেতে না উঠলে হয়তো পিএসজিকে সোনার হরিণের দেখাটাও পাইয়ে দিতে পারতেন টুখেল!

এমন ঠিকুজিই টুখেলকে কোচ করার জন্য ভাবিয়েছে চেলসিকে। যদিও ২০১৭ সালেই তাকে দেখা যেত ইংলিশ ক্লাবটিতে, যখন তিনি সবে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়েছিলেন। সে যাত্রায় দু’পক্ষের বনিবনতা না হলেও এবার হয়েছে, যখন প্রিমিয়ার লিগে চেলসির দারুণ শুরুটা খাবি খাচ্ছে এক মাসের ব্যবধানে। 
একে টুখেল অবশ্য দেখছেন ইংল্যান্ডে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ হিসেবে। তার চোখে প্রশংসিত দুই কোচ পেপ গার্দিওলা ও ইয়ুর্গেন ক্লপ যেমন নিজেদের প্রমাণ করেছিলেন প্রিমিয়ার লিগে। এবার পালাটা তার। 

কৌশলগত দূরদর্শিতা

প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ করতে টুখেলের তূণের সবচেয়ে বড় তীরটা হবে তার কৌশলগত দূরদর্শিতা। কোচিং জীবনের শুরুর দিকে দ্রুতলয়ের পাসিং ফুটবলের অনুসারী ছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছেন ক্লপের ফেলে আসা বরুসিয়ার হেভিমেটাল ‘গেগেনপ্রেসিং’-এর সঙ্গে। এরপর পিএসজিতে নিজের কৌশলকে ভেঙে গড়েছেন বহুবার। প্রথম মৌসুমে এক ফরাসি লিগেই ৩-৪-২-১ থেকে ৪-২-৩-১ পর্যন্ত সর্বমোট দশটা ছকে বাজিয়ে দেখেছিলেন দলকে, যা কোচ হিসেবে তাকে আরও কৌশলগতভাবে নমনীয়তা এনে দিয়েছে তাকে। যার সুবাদেই তো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দুর্দমনীয় বায়ার্নকে দমিয়ে রেখেছিলেন একটা বড় সময় ধরে! সেটা চেলসিতে ধরে রাখতে পারলে সফলতা এসে ধরা দেবে বৈকি!

চেলসিরও চাই সেটাই। সাজঘরে বড় বড় খেলোয়াড় রেখেও প্রিমিয়ার লিগে নবম স্থানে নেমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইংলিশ সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছিল খেলোয়াড়দের প্রতি কৌশলগত নির্দেশের অভাবকে, যেটা খোদ চেলসি খেলোয়াড়রা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছিলেন সংবাদ মাধ্যমে। 

জার্মান এই কোচের অতীত বলছে তিনি খেলোয়াড়দের খাদ্যাভ্যাস পরিকল্পনা, ঘুমের প্যাটার্ন নজরদারিতে রাখা থেকে শুরু করে দলের স্বার্থে অ্যানালিটিকস বিভাগ কিংবা স্কাউটিং বিভাগে পরিবর্তন আনেন তিনি। তার কাছ থেকে আর যাই হোক কৌশলগত নির্দেশনার অভাব হবে না খেলোয়াড়দের জন্য। গেল দলবদলে দলের দুই দামি খেলোয়াড় কাই হ্যাভার্টস আর টিমো ভের্নারের ব্যর্থতার পেছনে কাজ করেছিল ল্যাম্পার্ডের সঙ্গে তাদের ভাষাগত পার্থক্য। জার্মান ভাষাভাষী টুখেলের অধীনে অন্তত সে সমস্যায় পড়তে হবে না তাদের। গত মৌসুমে বুন্ডেসলিগার অন্যতম সফল দুই খেলোয়াড় চেলসিতে নিজেদের ছন্দ ফিরে পেলে যে ব্লুজরাও সাফল্যের ধারায় ফিরবে, তা বলাই বাহুল্য। দলের দুই খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ আর থিয়াগো সিলভার সঙ্গে আগেও কাজ করেছেন টুখেল। এ সম্পর্কগুলো দলের সঙ্গে দ্রুত পরিচিত করতেও সাহায্য করতে পারে তাকে।

ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংঘাত

ক্লাবের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকে অতীতে বেশ ক’বার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সমস্যায় জড়িয়েছেন টুখেল। বিষয়টা রোমান আব্রাহামোভিচের চেলসিতেও যদি ঘটে, সেক্ষেত্রে অকালে পদ খোয়াতে হতে পারে তাকে।

ডর্টমুন্ডে থাকাকালে দর্শনগত পার্থক্যের কারণে প্রধান স্কাউট সভেন মিসলিন্টাটকে দলে নিষিদ্ধই করে দিয়েছিলেন টুখেল। বরুসিয়া ক্রীড়া ব্যবস্থাপক মাইকেল জর্ক আর প্রধান নির্বাহী হ্যান্স জোয়াকিম ওয়াটজকের কাছে চেয়ে বসেছিলেন নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড় যা ছিল না সভেনের তালিকায়। তার প্রস্থানের পর ওয়াটজকের জানিয়েছিলেন, মাঠে সফল সময় কাটালেও মাঠের বাইরে ক্লাবের সঙ্গে তার সম্পর্কটা সবসময় ততটা সুখকর ছিলো না। আর পিএসজিতে লিওনার্দোর সঙ্গে তার সংঘাতটা তো পরিষ্কারই ছিল!

চেলসিতে সহসাই তেমন কিছুর সম্ভাবনা কম। তবে আসছে গ্রীষ্মে দুই পক্ষের মাঝে অতীতের পুনরাবৃত্তির শঙ্কা প্রবল। যদিও টুখেলের প্রতি ভক্তিটা রোমান আব্রাহামোভিচ তাকে দলে টানার সময়ই প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সেটা লিওনার্দো কিংবা জোয়াকিম ওয়াটজকের মতো হয়ে যায় কিনা তা সময়ই বলে দেবে। আর তা নির্ভর করছে তার একনায়ক বনে যাওয়া কিংবা কৌশলি হওয়ার ওপরই!

এনইউ/এটি