‘মানুষ মনে করেছিল আমি বোধ হয় পাগল’ গাম্বিয়ার কোচের দায়িত্বটা নেবেন বলে যখন ঠিক করলেন, তখনকার অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন টম সেইন্টফিট। এখন? পাঁচ বছরে একটিও বাছাই পর্বের ম্যাচ জিততে না পারা দলটিকে তিনি নিয়ে গেছেন আফ্রিকান কাপ অব নেশন্সের শেষ ষোলোতে।

সোমবার এই পর্বে তারা লড়বে ক্যামেরুনের বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বে মউরিটানিয়ার বিপক্ষে জয় ও সাবেক চ্যাম্পিয়ন তিউনিশিয়া এবং মালির বিপক্ষে ড্রয়ে এই পর্বে পৌঁছেছিল তারা। তাতে বড় কৃতিত্বটা সেইন্টফিটের। এবার তার সম্পর্কে চমকে দেওয়ার মতো একটা তথ্য দেই। তিনি এক সময় ছিলেন বাংলাদেশের কোচ।

২০১৬ সালে কয়েক মাসের জন্য এই দায়িত্বে ছিলেন সেইন্টফিট। তখন ঘটেছিল বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম লজ্জার পরাজয়। ভুটানের বিপক্ষে হেরে প্রায় দু বছরের জন্য এক রকম অঘোষিত নির্বাসনে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় দল।

তবে গাম্বিয়াতে কিন্তু তিনি ঠিকই সফল। প্রথমবারের মতো তাদের আফকনেই খেলাননি। তুলেছেন টুর্নামেন্টটির শেষ ষোলোতেও। এরপর তিনি শুনিয়েছেন নিজের গল্প, কীভাবে একটু একটু করে বড় করলেন আফ্রিকার ছোট্ট এক দেশের স্বপ্ন। বলেছেন, পৃথিবী পর্যটক না, তিনি হতে চেয়েছিলেন কোচই।

‘আমি পৃথিবী পর্যটক শব্দটা পছন্দ করি না। পুরো পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছি কোচ হিসেবে কোচিং করার জন্যই, পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াতে না।’ ৪৮ বছর বয়সী কোচ এএফপিকে বলেছেন এমন। 

এখন থেকে ২৪ বছর আগে কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। বেলজিয়ামের নিচের স্তরের ক্লাব দিয়ে শুরু। খেলোয়াড় হিসেবেও ক্যারিয়ারটা লম্বা করার ইচ্ছেই ছিল। কিন্তু পায়ের লিগামেন্ট একে একে ছিঁড়ে যায় ছয় বার। তাতে থামতে হয় মাত্র ২৪ বছর বয়সেই।

তখনই শুরু করেন কোচিং। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়ই পাড় করেছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়িয়ে। আফ্রিকাতেই গাম্বিয়ার আগে ছিলেন আরও সাতটি দেশের কোচ। ছিলেন কাতার অনূর্ধ্ব-১৭ দলের কোচও।
 
‘আমার অনেক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। কিন্তু জীবনে সত্যিকারের গল্প একটাই-গাম্বিয়াকে নিয়ে আফকনে আসা। আমি আমার দলকে নিয়ে গর্বিত।’ গাম্বিয়া নদীর পাড়ের আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়ার দেশের মানুষের সুদূরতম কল্পনাকে বাস্তব করা এই নায়ক বলছিলেন এমন।

গাম্বিয়া এর আগে কখনো খেলতে পারেনি আফকনে। ২৪ দলের এই টুর্নামেন্টে তো দূরে থাক, সেইন্টাফার্ট আসার আগে পাঁচ বছর জিততে পারেনি বাছাই পর্বের ম্যাচও। 

ওই কথা শোনাচ্ছিলেন সেইন্টফিট, ‘আমি যখন ২০১৮ সালের জুলাইতে এখানে এসেছি। গাম্বিয়া তখন পাঁচ বছর কোনো বাছাই পর্বের ম্যাচও জেতেনি। শেষ জয়টা এসেছিল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তানজানিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে।’

‘এখানে কোনো আশা ছিল না। ফিফা র‌্যাঙ্ককিংয়ে গাম্বিয়া ছিল ১৭২তম। আমি এসে বললাম, গাম্বিয়াকে আফকনে নিতে চাই। লোকজন ভাবা শুরু করল আমি বোধ হয় পাগল।’

‘আমি নিজের খরচে ইউরোপজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। গাম্বিয়ার বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের বুঝিয়েছি জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে। আমি জানি ফেডারেশনের এত অর্থ নেই। তাই হয় আমাকে ঘরে বসে থাকতে হবে অথবা নিজের টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। টাকা আমাকে কখনোই অনুপ্রাণিত করতে পারেনি।’ গাম্বিয়ার সফলতার পথ তৈরির গল্পটা বলছিলেন সেইন্টফিট।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে নেমেছিল গাম্বিয়া। সেটিই ছিল সেইন্টফিটের অধীনে তাদের প্রথম ম্যাচ। ওই ম্যাচের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল বলছিলেন সেইন্টফিট, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টস স্টেডিয়ামে সেদিন ৪৫ হাজার দর্শক ছিল। অথচ সেটার ধারণ ক্ষমতা ছিল কেবল ২৫ হাজার।’

‘আমি দেখলাম- ফ্লাডলাইট জড়িয়ে ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, স্কোরবোর্ডও। সবদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। দেড় ঘণ্টা পর ম্যাচ শুরু হলো। আর আমরা রিয়াদ মাহরেজ ও তার দলকে আটকে দিলাম।’

ইউরোপ থেকে খুঁজে খুঁজে খেলোয়াড় নিয়ে এসেছিলেন সেইন্টফিট। কিন্তু তাকে তাদের একসঙ্গে খেলাতেও অভ্যস্ত করতে হতো। ওই গল্পও বলেছেন সেইন্টফিট।

‘আমি নিজের পরিকল্পনা বদলে ফেললাম। মাঠ ও বাইরে নিয়মানুবর্তীতা আনলাম। আমার পেছনে খুব ভালো একটা ফেডারেশনও ছিল। আমার স্বপ্ন বিশ্বকাপ খেলতে নিয়ে যাওয়া গাম্বিয়াকে। কিন্তু আমি বাস্তববাদী। জানি, আমি আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম বা ফ্রান্সে মতো দলের কোচ না।’

সেইন্টফিট নিজেকে বাস্তববাদী বলছেন বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে। কিন্তু কেইবা জানতো তিনি চলে আসবেন এতটুকু? তাকে যে মানুষরা পাগল বলেছেন, ভুল হয়ে যাবেন তারা সেটাই বা কে জানতো। ফুটবল তো পাগলামীরই খেলা। আর স্বপ্ন? সেটা কীভাবে দেখাতে হয় তা তো সেইন্টফিটই করে দেখালেন। গাম্বিয়াকে বিশ্বকাপে দেখলেও তাই খুব অবাক হওয়ার কী থাকবে!

এমএইচ