বুয়েন্স আয়ার্সের রাস্তায় অন্য সব বালকের মতো গিদো বারিয়েরসের শৈশব কেটেছে ফুটবল নিয়েই। ফুটবল নিয়ে বেড়ে ওঠা গিদোর পথটা বদলে যায় বাবা আর্নেস্তার জন্য। অল্প বয়সে তিনি দেখেছেন বাবা আর্জেন্টিনা হকি দলের অধিনায়ক ও কয়েক বারের সেরা খেলোয়াড়। বাবার পথ ধরে তাই হকিতে এসেছেন গিদো।

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ইতোমধ্যে অর্ধ শতাধিক ম্যাচ খেলেছেন। বিশ্বকাপ, ওয়ার্ল্ড হকি, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সহ সব টুর্নামেন্টেই খেলেছেন এই আর্জেন্টাইন, শুধু অলিম্পিক ছাড়া। জার্মান লিগে খেলা আর্জেন্টাইন তারকা বাংলাদেশে সাইফ পাওয়ার খুলনার হয়ে ফ্রাঞ্চাইজ হকি খেলতে এসেছেন।
 
ঢাকায় এসেছেন মাত্র দিন চারেক। এর মধ্যেই আর্জেন্টাইন ভক্তরা তার মন জয় করেছে, ‘ঢাকার রাস্তায় অনেক আর্জেন্টিনার জার্সি দেখতে পাচ্ছি। এটা আমার জন্য দারুণ আনন্দের। হকি স্টেডিয়ামে দেখেছি অনেকে আর্জেন্টিনার জার্সি পড়ে খেলা দেখতে এসেছে। রাস্তায় আসা যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনার পতাকাও দেখেছি অনেক।’

ভক্তদের পাশাপাশি মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে আয়তনও তাকে মুগ্ধ করেছে, ‘আমাদের দেশে গ্যালারী এক দিকে। এখানে দেখলাম চার দিকে বসেই খেলার ব্যবস্থা আছে। স্টেডিয়ামের আয়তনও বেশ বড়।’ আর্জেন্টিনার হকি স্টেডিয়ামের গ্যালারী এক দিকে হলেও অনেকগুলো হকি টার্ফ, ‘আমি আর্জেন্টিনায় যে ক্লাবে খেলেছি, সেই ক্লাবের দুইটা হকি মাঠ। পুরো আর্জেন্টিনা জুড়ে প্রায় শ’খানেক হকি স্টেডিয়াম রয়েছে।’

ক্রীড়া বিশ্বে আর্জেন্টিনা ফুটবল দিয়েই পরিচিত। পুরুষদের খেলার মধ্যে ফুটবল আর নারীদের মধ্যে হকি এক নম্বর বলে জানালেন এই আর্জেন্টাইন, ‘ফুটবল আর্জেন্টিনার রক্তে এবং অনেকটা ধর্মের মতো। পুরুষ ফুটবলের পরেই নারী হকির অবস্থান। ২০০০ সালের পর নারী হকি দল দুই বার অলিম্পিকে রৌপ্য জিতেছে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। ফলে নারী হকির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ছেলেরা যেমন ফুটবল নিয়ে মাতে, নারীরা তেমনি হকি নিয়ে।’

বাবাকে অনুসরণ করে হকি খেলোয়াড় হলেও ফুটবলপ্রেম এখনো রয়েছে। বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন প্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়ার্সের জার্সি। তার মা বোকার অন্ধ সমর্থক, ‘আমি রিভারপ্লেটকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না। আমার মা বোকার অন্তঃপ্রাণ সমর্থক। আমিও বোকাকে সমর্থন করি ছোট বেলা থেকে।’

বোকা জুনিয়ার্সের জার্সিতে খেলেছেন দিয়োগা ম্যারাডোনা। তাই ম্যারাডোনার প্রতি বিশেষ ভালোবাসা তার, ‘ম্যারাডোনার মারা যাওয়ার দিন অনেক কেঁদেছিলাম। আমার মাও বেশ বিষন্ন ছিলেন।’ ফুটবল ঈশ্বর খ্যাত ম্যারাডোনা দুই বছর ধরে নেই পৃথিবীতে। এরপরও জনপ্রিয়তা যথেষ্ট আর্জেন্টিনাতে, ‘মেসি এবং ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনায় জনপ্রিয়তায় সমানে সমান। কখনো বা কোনো জায়গায় ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা বেশি আবার কিছু জায়গায় মেসির। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মেসির সমর্থন বেশি আর মধ্য বয়স্করা ম্যারাডোনার সমর্থক বেশি।’

বছর তিনেক আগে যুব অলিম্পিক হয়েছিল বুয়েন্স আয়ার্সে। বাংলাদেশ যুব হকি দলের হয়ে সেই সফরে ছিলেন সাইফ পাওয়ার খুলনার আইকন খেলোয়াড় গোলরক্ষক বিপ্লব কুজুর। সেই স্বল্প কয়েক দিনের সফরে তার কাছে ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তাই বেশি মনে হয়েছে, ‘ম্যারাডোনার সমর্থকই বেশি মনে হয়েছে। ম্যারাডোনা একবার চ্যাম্পিয়ন করিয়েছে। মেসি এখনো বিশ্বকাপ জেতাতে না পারায় তার অবস্থান কিছুটা পেছনে আর্জেন্টিনায়।’

হকির সূত্রে গিদোর এখন বেশি সময় কাটে জার্মানিতে। আর্জেন্টিনার তুলনায় জার্মানি হকি পেশাদারিত্বে এগিয়ে, ‘আর্জেন্টিনায় যে ক্লাবের হয়ে খেলতাম তাদের দুটো মাঠ। জার্মান ম্যানহেইমার ক্লাবেরই রয়েছে চারটি মাঠ। অবকাঠামো, পেশাদারিত্ব সব দিক থেকেই জার্মান হকি এগিয়ে।’ ম্যানহেইমার লিগে খেলা গিদোর জার্মান সতীর্থ মট্রিজ ফ্রেও বাংলাদেশে এসেছেন সাইফ পাওয়ার খুলনায় খেলতে। একই রুমে থাকছেন দুই সতীর্থ।

হকির ব্যস্ততার পর গিটার বাজিয়ে অবসর কাটে গিদোর। বাংলাদেশেও বয়ে এনেছেন নিজের প্রিয় গিটার। টিম হোটেলের রুমে আলোচনার এক ফাকে গিটারে সুর তুললেন। গায়কদের মধ্যে তার আদর্শ বব মার্লে। শরীরে মার্লের ট্যাটুও রয়েছে। শরীরে সব মিলিয়ে দশটি ট্যাটু। হাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীর ট্যাটু থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম অনুসরণ করেন না এই আর্জেন্টাইন, ‘সকল ধর্মাবলম্বীর প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। সুনির্দিষ্ট কোনো র্ধম অনুসরণ করি না। আমার বাবা-মাকে দেখেছি ছোট বেলায় চার্চে যেতে। এখন অবশ্য তারাও কঠোরভাবে ধর্ম অনুসরণ করেন না।’

৩২ বছর বয়স হলেও এখনো একাই রয়েছেন গিদো। আর্জেন্টাইন পুরুষরা আরো বিলম্বে বিয়ে করে বলে জানালেন, ‘বাংলাদেশ, ভারতের প্রেক্ষাপটে ৩২ বছর বয়সে বিয়ে না করা একটু অস্বাভাবিক। তবে আমাদের আর্জেন্টিনায় খুবই স্বাভাবিক। ২০-৩০ বছর বয়সে সবাই শিক্ষা ও কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ৩০-৪০ এর মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা বেশি।’

এজেড/এনইআর