বাংলাদেশের হকির সঙ্গে গত কয়েক বছর বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন মালয়েশিয়ান কোচ গোপীনাথান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন। চার বছর পর আবারও তার উপর আস্থা রাখে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। ২০২০-২২ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) হকির উপদেষ্টা কোচ ছিলেন। দুই বছর বিকেএসপিতে কাজ করার পর গত মাসের শেষ সপ্তাহে ফিরে গেছেন নিজ দেশ মালয়েশিয়ায়। জিমিদের সাবেক কোচ বাংলাদেশের হকির নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে কথা বলেছেন সুদূর মালয়েশিয়া থেকে।  

বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার আনুষ্ঠানিক পথচলা শেষ হয়ে গেল...
গোপীনাথান: বাংলাদেশ আমার সেকেন্ড হোম। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের শেষ বলতে চাই না। আনুষ্ঠানিক পথচলার একটু ইতি ঘটল। বিকেএসপি আমার সঙ্গে চুক্তি নবায়নে আগ্রহী ছিল। আমি নবায়ন করেনি কারণ আমার মালয়েশিয়ায় ফেরা প্রয়োজন ছিল। 

আর্থিক বা অন্য কোনো কারণে বিকেএসপির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেননি নাকি!
গোপীনাথান: আর্থিক বিষয়ে তেমন দূরত্ব ছিল না আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে। মূল বিষয় হচ্ছে মালয়েশিয়ায় আমি একটি ব্যাংকে চাকুরি করি। সেখানে দুই বছরের বেশি সময় ছুটিতে ছিলাম। ব্যাংক থেকে আমাকে আর ছুটি দিচ্ছে না। তাই ফিরে যেতে হয়েছে মালয়েশিয়ায়। 

আপনি পেশাদার হকি কোচ হয়ে ব্যাংকে চাকুরি করছেন?
গোপীনাথান: বাংলাদেশে যেমন সোনালী ব্যাংক হকির সঙ্গে দীর্ঘদিন। তেমনি মালয়েশিয়ায় মে ব্যাংকও হকির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি এই ব্যাংকের হয়েই খেলেছি। পরবর্তীতে শিক্ষাগত যোগ্যতার মাধ্যমে এই ব্যাংকে চাকুরি নিয়েছি। 

ব্যাংকিং এবং হকি কোচিং কিভাবে সমন্বয় করেন ?
গোপীনাথান: ২৫ বছর ধরে আমি মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রয়াত্ত এই ব্যাংকে রয়েছি। কোচিংয়ের জন্য তারা আমাকে ছাড় দেয়। বিকেএসপিতে যখন ছিলাম তখন বিনা বেতনে ছুটিতে ছিলাম। তখন সহকর্মী সংখ্যা বেশি থাকায় হয়তো ছুটি পেয়েছিলাম। এখন কাজের চাপের ব্যস্ততায় আমাকে ডেকেছে। 

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ দল এএইচএফ কাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই দলের অনেকেই বিকেএসপির বর্তমান শিক্ষার্থী আবার অনেকে সাবেক। বিকেএসপির উপদেষ্টা কোচ হিসেবে এই সাফল্যকে কিভাবে দেখছেন ?
গোপীনাথান: খেলাধুলায় শিরোপা পাওয়া অবশ্যই দারুণ। তবে এএইচএফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। এটা হকির কোনো স্ট্যান্ডার্ড হতে পারে না। 

আপনি বিকেএসপিতে দুই বছর ছিলেন। তরুণ খেলোয়াড়দের কিভাবে তৈরি করেছেন? 
গোপীনাথান: বিকেএসপির বর্তমান শিক্ষার্থীরা হকিতে দারুণ করবে। তাদেরকে আধুনিক হকির দীক্ষাই দিয়েছি। ফ্র্যাঞ্চাইজি হকির সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে একজন সম্পৃক্ত থাকায় অনেকের দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার দুই বছরের কাজের মাধ্যমে আশা করি বাংলাদেশ বিকেএসপিতে থেকে আরো বেশি পরিপক্ব খেলোয়াড়ই পাবে। 

বাংলাদেশের হকির সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা কোথায় আপনার দৃষ্টিতে ?
গোপীনাথান: বাংলাদেশের হকি খেলোয়াড়রা অত্যন্ত মেধাবী। মালয়েশিয়া বিশ্ব হকির সেরা দশটির একটি। মালয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের চেয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মেধার তেমন পার্থক্য নেই। এএইচএফ টুর্নামেন্টে বিকেএসপির অনেকেই ছিল। সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যা পেলে জুনিয়র হকি বিশ্বকাপ খেলা বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব নয়। এই ছেলেরা ওমান থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পর এখানে যদি অনুশীলন না হয়, ম্যাচ খেলার সুযোগ না পায় তাহলে কিভাবে উন্নতি করবে। সমস্যা শুধু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। হকি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এই আধুনিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হতে পারলে হকির সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব না। বাংলাদেশের অনেকেই আধুনিক হকি বুঝেন না, তারা যে এটা জানেন না সেটাও বুঝতে চান না।

জাতীয় হকি দলে আপনি কয়েক মেয়াদে কাজ করেছেন সেখানকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল ?
গোপীনাথান: মাঝে বাংলাদেশের র‍্যাংকিং ৪১ ছিল। সেখান থেকে ২৭ এ এসেছে। দীর্ঘদিন তো খেলার বাইরে ছিল জাতীয় দল। কোচ এবং নির্বাচক কমিটির মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। হকিতে নির্বাচক কমিটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই রয়েছে শুধু। 

নির্বাচক কমিটির কী রকম সমস্যা দেখেছেন আপনি?
গোপীনাথান: নির্বাচক কমিটির সদস্যরা একেকজন একেক ক্লাবের। কেউ আবাহনী, কেউ মোহামেডান, কেউ উষার আবার কেউ মেরিনার্সের খেলোয়াড় নির্বাচনের জন্য মরিয়া থাকে। অনেক খেলোয়াড় আবার তাদের ঘনিষ্ঠ থাকে। দল নির্বাচনে পারফরম্যান্সের চেয়ে সম্পর্ক বড় হয়ে উঠে অনেক সময়। 

তাহলে তো দেশের চেয়ে ক্লাবের স্বার্থ বড়! 
গোপীনাথান: বাংলাদেশে অনেক দিন কাজ করেছি। সেখান থেকে অনেক সময় উপলব্ধি হয়েছে, এখানে বোধহয় ক্লাবের স্বার্থই বড় দেশের চেয়ে। অনেক সময় এমনটাও শুনেছি যে জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের কয়েকজনকে ক্লাব থেকে বলা হয় নাকি সেরাটা না খেলতে অথবা ইনজুরি লুকাতে। 

আপনার কাজের স্বাধীনতা কেমন ছিল?
গোপীনাথান: জাতীয় দলে দল নির্বাচনটা নির্বাচকরাই করতেন। বাকি বিষয়ে অবশ্য স্বাধীনতা ছিল। কোনো অযাচিত হস্তক্ষেপ ছিল না। বিকেএসপিতে দুই বছর দারুণ সময় কাটিয়েছি। যে কোনো কোচের জন্য কাজ করার আদর্শ জায়গা বিকেএসপি।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আপনার সুযোগ-সুবিধা হকি ফেডারেশন ও বিকেএসপি যথেষ্ট ভালোই দিয়েছে। দেশীয় অনেক শীর্ষ কোচরা আপনার চেয়ে কম সুবিধা পায়।
গোপীনাথান: আমি বাংলাদেশে এসেছিলাম পরিবার-পরিজন রেখে। একজন বিদেশি ব্যক্তিকে বেশিই সম্মানী দিতে হয়। আমি মালয়েশিয়ায় যদি কাজ করি, আমি যে অর্থ পাব অন্য দেশের কাউকে আনলে সে আমার চেয়ে বেশি পাবে এটা স্বাভাবিক।

এজেড/এনইআর/এটি