চৈত্রের কড়া দুপুর। রমজান মাসে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের টার্ফে রোদের তাপের উত্তাপটা একটু বেশিই লাগে। এরপরও অন্য সবার মতোই বল, স্টিক নিয়ে ছুটছেন দাড়িওয়ালা এক খেলোয়াড়। দূর থেকে দেখলে খুব একটা বোঝার উপায় নেই ব্যাচেলর স্পোর্টিংয়ের মিডফিল্ডার খাজা তৈয়ব রেজার বয়সটা ৪৮। 

হকি স্ট্যামিনানির্ভর খেলা। এই বয়সেও বলের পেছনে হরদম ছুটেন তৈয়ব। এখনো হকি উপভোগ করেন এবং বল দখলের তীব্র নেশা তৈয়বের, ‘বলের পেছনে ছুটে বেড়াতে এখনো ভালো লাগে। দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে আমিই সবচেয়ে সিনিয়র বেশ কয়েক বছর থেকেই। তাই ছোটদের সামনে মাঝে মধ্যে মিস পাস বা বল ধরতে না পারলে একটু খারাপ লাগে।’ 

হকি লিগ অনিয়মিত। এখন জিমি-চয়নরা সার্ভিসেস বাহিনীতে কাজ করলেও আগে সেই সুযোগ ছিল না। তাই রুটি-রুজির জন্য অন্য পেশাতেও মনোযোগ দিতে হয়েছে তৈয়বকে, ‘আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ে কাজ করি। লিগ চললে মাঝে মধ্যে ছুটি নেই। সাধারণত আগের দিন ও খেলার দিন ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করি। এত বয়স ও কাজের চাপ থাকলেও লিগের সময় অনুশীলনে আমি নিয়মিত থাকি’।

১৯৮৭ সালে তৈয়ব লিগ খেলা শুরু করেছিলেন। প্রায় তিন যুগ এই স্টিক, বল নিয়ে থাকার পর আগামী ৮ এপ্রিল সব তুলে রাখতে চান, ‘অনেক দিন খেলেছি। বয়সও হয়েছে অনেক। এখন বিদায় নিতে চাই। ৮ এপ্রিলই আমার শেষ ম্যাচ।’ 

হকি সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, জুম্মন লুসাই (প্রয়াত),আব্দুল মালেক চুন্নু (প্রয়াত) ও জামাল হায়দার তৈয়বের চেয়েও বেশি বয়স নিয়ে হকি খেলেছেন। তৈয়বের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি বয়স পর্যন্ত হকি খেলার। তবে তৈয়বের দাবি বাংলাদেশে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় হকির মাঠে, ‘আমার চেয়ে বেশি বয়সে হয়তো দুই-একজন খেলে থাকতে পারে। কিন্তু টানা ৩৬ বছর হকি খেলার রেকর্ড বোধ হয় একমাত্র আমারই’। ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনে বর্তমানে দলীয় খেলায় সবচেয়ে বেশি বয়স্ক খেলোয়াড়ের তালিকায় তৈয়ব দ্বিতীয় স্থানে। ৫০ বছর বয়সে প্রথম বিভাগ ফুটবল খেলছেন মোহাম্মদ আলী।

জুম্মনরা শীর্ষ পর্যায়ে ( প্রিমিয়ার লিগ) খেললেও তৈয়ব গত কয়েক বছর এক ধাপ নিচে প্রথম বিভাগে খেলছেন। ব্যাচেলর স্পোর্টিং থেকে তার ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চান, ‘ব্যাচেলর দলটা নবাব বাড়ির। নবাব বাড়ির সন্তানদের নিয়েই এই দল গঠিত হয়। আমাকে অনুরোধ করেছে খেলার জন্য। তাই খেলে যাচ্ছি, নিজেদের ক্লাব থেকেই এবার অবসরে যাব।’

তৈয়বের ক্যারিয়ারে স্বর্ণযুগটা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ক্লাব ওয়ারীতে। ১৯৮৯-৯৫ পর্যন্ত ওয়ারীতে খেলেছেন তৈয়ব। পাঁচ বছরের বেশি একটানা ওয়ারীতে খেলায় ক্লাব থেকে বন্ধুও পেয়েছিলেন। ওয়ারীর পর সাধারণ বীমা, উষা,সোনালী ব্যাংকের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন এই মিডফিল্ডার। সিনিয়র জাতীয় দলের জার্সি কখনো পরা না হলেও জুনিয়র জাতীয় দলে ছিলেন,‘ ২০০৪-০৫ সালের দিকে অ-২১ টুর্নামেন্টে আমাকে দলে নেওয়া হয়েছিল। যদিও তখন আমার বয়স ২৫ এর বেশি। আমি ফেডারেশনকে না করা সত্ত্বেও দলে নিয়েছিল’।

বাংলাদেশকে তৈয়ব প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলেও তৈয়বের বাবা খাজা ইউসুফ রেজাকে বাংলাদেশের হকির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হিসেবেই ধরা হয়। হকি অঙ্গনে জনশ্রুতি রয়েছে, হকির জাদুঘর ধ্যানচাদের সঙ্গে স্টিক লড়াইয়ে তিন বারের মধ্যে দুই বারই ইউসুফ রেজা জিতেছিলেন। এরপর থেকে তার উপাধি হয় ‘ঢাকা ম্যালম্যাল’।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে হকির অন্যতম কিংবদন্তি আব্দুস সাদেকও খাজা ইউসুফ রেজার উচ্চ প্রশংসাই করলেন, ‘সে অত্যন্ত উঁচু মাপের খেলোয়াড় ছিলেন। আমরা খেলা শুরুর করার অনেক আগেই অবশ্য তিনি খেলা ছেড়েছেন। ধ্যানচাদের সঙ্গে তার খেলার অভিজ্ঞতা ছিল।’

বাংলাদেশকে তৈয়ব প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলেও তৈয়বের বাবা খাজা ইউসুফ রেজাকে বাংলাদেশের হকির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হিসেবেই ধরা হয়। হকি অঙ্গনে জনশ্রুতি রয়েছে, হকির জাদুঘর ধ্যানচাদের সঙ্গে স্টিক লড়াইয়ে তিন বারের মধ্যে দুই বারই ইউসুফ রেজা জিতেছিলেন। এরপর থেকে তার উপাধি হয় ‘ঢাকা ম্যালম্যাল’। 

তৈয়ব ১৯৮৭ সালে হকি লিগে খেলা শুরুর বছর দুই পরই খাজা ইউসুফ রেজা মারা যান। নিজের ক্যারিয়ারে বাবার সান্নিধ্য সেভাবে না পেলেও তৃপ্ত তৈয়ব,‘আমার ক্যারিয়ার জুড়ে দেখেছি বাবার প্রতি হকি অঙ্গনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলেও বাবার প্রিয় হকির সঙ্গে ছিলাম সেটাতেই আমি খুশি’। 

এফআই