হকিই ছিল শামসুল বারীর ধ্যান-জ্ঞান, চিরনিদ্রার পর তার জানাজাটাও হলো এই হকি স্টেডিয়ামেই/সাদমান সাকিব

৭৫ বছরের জীবন। এর মধ্যেই ৫০ বছরই হকির সঙ্গে কাটিয়েছেন শামসুল বারী। হকির কিংবদন্তীর বিদায়ে করোনাকালেও হকি সংশ্লিষ্ট এসেছিলেন অনেকেই। 

ইমাম হোসেন চৌধুরি শান্টা তার অগ্রজের বিদায়ে খুবই আপ্লুত, ‘বারী ভাইয়ের সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি। এক সাথে খেলেছি। তার অধীনে অনেক কাজ করেছি। খেলোয়াড় তৈরিতেও তার ছিল যথেষ্ট নেশা।’ শান্টা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পুরস্কার জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেলেও শামসুল বারী পাননি। মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে শামসুল বারীর বিদায়ের দিন সেই অতৃপ্তির কথাই ফুটে উঠল তার সতীর্থ, শুভাকাঙ্খীদের কণ্ঠে। 

হকির অন্যতম নিবেদিত প্রাণ কর্মকর্তা ইউসুফ আলী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেও বারীর ক্রীড়া পুরস্কার না পাওয়ায় প্রচন্ড আক্ষেপ তার, ‘বারী ভাই পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও সে দারুণ খেলেছেন। আর সংগঠক হিসেবে তো অনন্য উচ্চতায়। ১৮ বছর হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। খেলোয়াড়, সংগঠক যে কোনো বিবেচনায় তিনি পুরস্কৃত হতে পারতেন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক প্রতি বছর দেয়া হলেও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার অনিয়মিত।’ 

২০১২ সালের পর থেকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান হচ্ছে না। পরের বছরগুলোর মনোনীতদের তালিকা হলেও এখনো গ্যাজেট প্রকাশ হয়নি। মনোনীতদের মধ্যে শামসুল বারীর নামও রয়েছে বলে জানা গেছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তার সন্তানদের বাবার মরণোত্তর পুরস্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

হকি ফেডারেশনের নির্বাচন একটি বড় জটিল বিষয়। সব সময় দুই পক্ষ হয়েই যায়। বার্ধক্যের কারণে শামসুল বারী গত এক দশকের বেশি সময় নির্বাচন থেকে দূরে। তবে তিনি কোনো পক্ষ-বিপক্ষে থাকতেন না। এই বিষয়টি সংগঠকদের জন্য শিক্ষণীয় মনে করেন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আব্দুর রশিদ শিকদার, ‘বারী ভাই সংগঠকদের সংগঠক। হকি ফেডারেশন মানেই বারী ভাই। তিনি যখন সেক্রেটারি ছিলেন ছোট বড় ক্লাবের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। আবার যখন ফেডারেশনের বাইরে তখন পক্ষ বিপক্ষে জড়াতেন না। যেটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।’ 

শামসুল বারী একেবারে তৃণমূল থেকে ক্রীড়াঙ্গনে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। তার ক্লাব অ্যাজাক্স স্পোর্টিং। অ্যাজাক্স থেকে ফেডারেশনে, ফেডারেশন থেকে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন, দেশের গন্ডি পেরিয়ে এশিয়ান হকি ফেডারেশনেও ছিলেন বারী। আজ বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সঙ্গে এশিয়ান হকি ফেডারেশনের অসাধারণ সম্পর্ক। এর সেতুবন্ধনকারী ছিলেন বারীই, ‘আমরা এখন এশিয়ান হকি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটিতে রয়েছি। এশিয়ার পুরনো হকি সংগঠকরা আমাদেরকে জিঞেস করে এখনো বারী ভাইয়ের কথা। আমরা বারী ভাইয়ের মাধ্যমে সেখানে পৌছাতে পেরেছি’-বলেন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও এশিয়ান হকি ফেডারেশনের সদস্য সাজেদ এ আদেল। 

বারীর ক্লাব অ্যাজাক্সের যুগ্ম সম্পাদক মাখন কান্না ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, ‘অ্যাজাক্স মানেই বারী ভাই। আমরা এতিম হয়ে গেলাম।’ বারী দু’সন্তান এসেছিলেন বাবার জানাজায়। বারীর ছেলে আরিফ খানিকটা দুঃখ নিয়েই বলেন, ‘বাবা শেষ সময়ে অনেক অসুস্থ ছিলেন। এরপরও হকির খোজ রাখতেন। হকির ভালো সংবাদে শারীরিক উদ্দীপনা ফিরে পেতেন। বাবা যে জায়গায় হকিকে দেখতে চেয়েছিলেন সেই জায়গা দেখে যেতে পারলেন না।’ 

বারীর প্রিয় হকি অঙ্গনের শেষ বারের মতো এক ঘন্টার কম সময় ছিলেন। এর মধ্যেই বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন, অ্যাজাক্স ক্লাব, মোহামেডান,আবাহনী, উষা ক্রীড়া চক্র, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন, ঢাকা মেরিনার ইয়াংস সহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা শেষ বারের মতো হকির কিংবদন্তীকে শ্রদ্ধা জানায়। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে বনানীতে চিরশায়িত হন আদ্যোপান্ত এই হকি প্রাণ বারী। 

এজেড/এনইউ