স্বাধীনতাত্তোর দেশের তিন শীর্ষ ক্রীড়া ফেডারেশন ফুটবল, হকি ও ক্রিকেটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবুল হাশেম, মাহমুদ উর রহমান মোমিন ও মোজাফফর হোসেন পল্টু। তিনজনই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ক্লাব ওয়ারীর কর্মকর্তা। স্বাধীনতার পর হকি ফেডারেশনই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে সবার আগে। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে অন্যতম অবদান মোমিনের। 

দেশের হকির অন্যতম কিংবদন্তি আবদুস সাদেক মোমিনকে সবচেয়ে বেশি অবদান দিচ্ছেন হকির জন্য আলাদা মাঠ ও স্টেডিয়াম পাওয়ার জন্য, ‘স্বাধীনতার আগে ও পরে কিছু সময় আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ইনারে ও আউটডোরে হকি খেলেছি। আজকে যেখানে হকি স্টেডিয়াম সেখানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কয়েকটি ডিসিপ্লিন একসঙ্গে কিছু ব্যবহার করতে পারে এমন স্থাপনা তৈরি করছিল। সেটিকে সম্পুর্ণ হকি ও আলাদাভাবে হকির জন্য করার পেছনে অবদানটা মোমিন ভাইয়ের।’

দেশের হকির অনেক কালের সাক্ষী ইউসুফ আলী। তিনি সংগঠক মোমিনকে বিশ্লেষণ করলেন এভাবে, ‘স্বাধীনতার পরপর আমাদের জাতীয় হকি ঢাকার বাইরে দুই জেলায় হয়েছে। হকিকে বিকেন্দ্রীকরণের পেছনে তার ভুমিকা প্রশংসনীয়।’

 ১৯৭২-৮১ পর্যন্ত হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এশিয়া কাপের আয়োজক হয়। তখন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মির্জা ফরিদ আহমেদ মিলু। ফেডারেশনের কমিটির বাইরে থাকলেও ততকালীন ফেডারেল সভাপতি মোমিনের উপরই এশিয়া কাপের সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। সফল এশিয়া কাপের পেছনে মোমিনের অবদান সম্পর্কে ইউসুফ বলেন, ‘মোমিন ভাইয়ের সাংগঠনিক দক্ষতার জন্যই টুর্নামেন্টটি সফল হয়। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সুনাম হয়।’

গত দুই যুগে বাংলাদেশের হকিতে রাজনীতি ও নোংরামি ভর করেছে। মোমিন ছিলেন এসবের উধ্বে। তিনি গত দুই দশকে হকি ফেডারেশনে সেভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না। হকি ফেডারেশন নিয়ে কোনো মন্তব্যও করেননি। 

বয়স ও নানা পারিপার্শ্বিকতা হকি ফেডারেশন থেকে দুরে থাকলেও নিজ ক্লাব ওয়ারীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমৃত্যু। ক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা তিনি। মাস দুয়েক আগেও ক্লাবে এসেছিলেন। বার্ধক্য ও রোগশোক মোমিনকে ওয়ারীতে আসা বন্ধ করতে পারেনি। ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মহিদুর রহমান মেরাজ বলেন, ‘প্রতি বুধবার বিকেলে মোমিন ভাই আসতেন। বুধবার দিন ক্লাবের সিনিয়রদের এক আড্ডা হতো। সেটা মোমিন ভাইয়ের নেতৃত্বেই।’

অন্য ক্লাবে যেখানে পরিচালক ও বোর্ড সভা অনিয়মিত সেখানে ব্যতিক্রম ওয়ারী। নির্বাহী কমিটির সভা তো হয়ই কয়েক মাস অন্তর অন্তর হয় উপদেষ্টা কমিটির সভা। গত দুই দশক যাবত পালাক্রমে উপদেষ্টা কমিটির প্রধান মোজাফফর হোসেন পল্টু ও মাহমুদ উর রহমান মোমিন। 

১৯৬৮-৭৭ পর্যন্ত মোমিন ওয়ারীর হকি কমিটির সম্পাদক। ১৯৭৮-৮৮ এই দশ বছর ছিলেন ক্লাবের সম্পাদক। তার সাধারণ সম্পাদক কালেই ওয়ারীর ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুগ। ক্রিকেট লিগে দুই বার রানারআপ, ফুটবল ও হকিতে চতুর্থ। মাঠের এই সাফল্যের চেয়ে অন্য আরেকটি কারণে মোমিনকে বেশি অবদান দিচ্ছেন বর্তমান সম্পাদক, ‘আশির দশকের পর ক্লাবগুলো মতিঝিলে স্থানান্তরিত হয়। এখানে জায়গা পাওয়া ও ক্লাবের কলেবর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোমিন ভাইয়ের অবদান অন্যতম।’ সেই প্রাচীনকালে থেকেই ওয়ারী ক্লাবের সভাপতি জেলা প্রশাসক। এখনও সেটা অনুসরণ হচ্ছে। 

স্বাধীনতার পর মোমিনের পরিচয় সম্পুর্নটাই সংগঠক। পাকিস্তান আমলে খেলোয়াড় হিসেবেও তার ছিল বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। পুর্ব পাকিস্তান হকি দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। তার সঙ্গে খেলা আবদুস সাদেক খেলোয়াড় মোমিনকে মুল্যায়ন করলেন এভাবে, ‘রাইট হাফে সে অত্যন্ত আক্রমণাত্নক খেলোয়াড় ছিলেন। অসাধারণ খেলোয়াড়ের পাশাপাশি সে স্টাইলিশও ছিল। স্কার্ফ পড়তেন খেলার সময়।’

হকি ছাড়া ফুটবলও খেলেছেন মোমিন। ১৯৮৬-৯০ সাল পর্যন্ত ফুটবল ফেডারেশনের কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন। জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন একবার।

খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান। কৃতি এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের জানাজা হয়েছে গতকাল তার প্রিয় ক্লাব ওয়ারীতেই। লকডাউন, করোনা শত বাধা সত্ত্বেও ওয়ারীর ও হকির মোমিন ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন অনেকেই। 

এজেড/এটি