রওশন আরা ছবি, বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের পথিকৃৎ। ষাটের দশকে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা বাধা অতিক্রম করে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ঝড় তুলতেন তিনি। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান আমলে দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন ছবি। হার্ডেলসে ছিল পাকিস্তান জাতীয় রেকর্ড। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্রীড়া বৈষম্যের একটা জবাবও ছিল ছবির সেই রেকর্ড। 

হার্ডেলসে রেকর্ড করা সেই ছবি এখন জীবন সায়াহ্নে এসে ‘কঠিন হার্ডেলসে’ পড়েছেন। স্বামী মহিউদ্দিন সেলিম বছর পাঁচেক ধরে প্যারালাইজড। স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না। নিজে চলার শক্তি নেই। হুইলচেয়ারে তাকে নিয়ে ঘরে চলাফেরা করেন ছবি। অসুস্থ স্বামীকে শুশ্রূষার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন সংগঠনে সময় দিয়ে যাচ্ছিলেন ছবি।

ছয় মাস আগে তার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আকস্মিক স্ট্রোক হয় ছেলে রাজুর। সেই স্ট্রোকের পর থেকে ছেলে তার কথাও বলতে পারেন না, চোখেও তেমন দেখতে পান না। হাসপাতালে মাস খানেকের বেশি সময় চিকিৎসাধীন থাকার পর এখন রাজধানীর শান্তিবাগের বাসায় অনেকটা অচেতন অবস্থায় আছেন রাজু। 

৭০ বছর বয়সে এসে স্বামী ও ছেলের এই অবস্থা নিজ হাতে সামলাচ্ছেন ষাটের দশকের এই সাহসী হার্ডলার, ‘আমার জীবনের শেষ সময়ে এমন হার্ডেলসের মুখোমুখি হবো কল্পনা করিনি। কত সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ছেলে ছিল আমার। এখন কঙ্কালসার দেহ। মা যখন ছেলের কথা শুনতে পারে না, এর চেয়ে কষ্ট আর কী হয়। হয়তো ও আমাকে দেখতেও পায় না ভালোভাবে। আমার জীবনও এখন অন্ধকারময়।’

শারীরিক এই কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক কষ্টও রয়েছে। ছেলের হাসপাতালে চিকিৎসা করার সময় খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ টাকা ৷ এখন প্রতি মাসে ছেলের চিকিৎসা ব্যয়ে লাগছে তিন লাখ টচাকার বেশি। ৭২ বছর বয়সে সেবার পাশাপাশি আর্থিক যোগানের সংস্থান করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন এক সময়ের দ্রুততম মানবী, ‘আমি ও আমার ছেলে একই স্কুলের (সেন্ট্রাল গভ.) শিক্ষার্থী। আমাদের স্কুলের সতীর্থরা খোঁজখবর রেখেছে। আর্থিক সহায়তা এসেছে আমার ব্যাংকার সহকর্মী, আমার ক্লাসমেট, ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে। তাদের সাহায্য আর আমার কিছু সঞ্চয়, সব শেষ।’

পাকিস্তান আমল থেকে সারাজীবন ক্রীড়াঙ্গনকে সময় দেয়া জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ক্রীড়াবিদের পাশে ক্রীড়া সমাজ সেভাবে নেই। ‘অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন যৎসামান্য আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল। এছাড়া আর কোথাও তেমন কিছু পাইনি। কেউ তেমন খোঁজও নেয় না।’ নিজের এত সংকটের মধ্যেও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ছবি। 

সত্তরের দশকে অসাধারণ খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন ছবি। জনতা ব্যাংক থেকে অবসরে গিয়েছেন ২০০৯ সালে। মুক্তিযোদ্ধা স্বামী সেলিম অবসরে যান পরের বছর। মুক্তিযোদ্ধা হলেও ভাতা নেওয়ার জন্য সুস্থ সময়ে আবেদন করেননি, যেন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পান। এখন আর আবেদন করার শক্তিও নেই একসময় মঞ্চ নাটক করা সেলিমের।

এক ছেলে ও মেয়ে নিয়ে অবসরকালীন সময়টা এ দম্পতির ভালোই কাটছিল। ২০১৬ সালে স্বামী প্যারালাইজড হওয়ার পর সংগ্রামের শুরু ছবির। আর এখন যোগ হয়েছে ছেলের অচেতন অবস্থা। ছবি নিজেও অসুস্থ। নিজের এক চোখের ছানি নষ্ট, হার্টে চারটি রিং পরানো। ছবির পরিবারের আরেক সদস্য তার মেয়ে। মাস্টার্স সম্পন্ন করা মেয়ে বিয়ে করে সংসার করছে। 

ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় লোন নিয়ে রাজধানীর শান্তিবাগে ছোট একটা বাড়ি করেছিলেন। অবসর বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকায় যা একটু স্বস্তি, ‘এই বাড়িটি না থাকলে কী যে হতো। চারতলার বাড়িতে আমি স্বামী নিয়ে থাকি তৃতীয় তলায়। চতুর্থ তলায় ছেলের চিকিৎসা চলে।’ দ্বিতীয় তলা ভাড়া দিয়ে চলত সংসার। এখন প্রতি মাসে স্বামী ও ছেলের চিকিৎসা করাতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সুলতানা কামালের সতীর্থ রওশন আরা ছবি। 

চার তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় উঠতেই দেখা মিলবে রওশন আরা ছবির পাকিস্তান আমলের নানা কীর্তি। খেলোয়াড়ি জীবনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের স্ত্রী কৃতি অ্যাথলেট সুলতানা কামালের সাথে রওশন আরা ছবির ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদের দুজনের চেহারার মিল ছিল অনেক, ছিল অসম্ভব বন্ধুত্বও, ‘খুকি (সুলতানা কামালের ডাক নাম) ও আমার অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিল। একই জামা পরে আমাদের অনেক ছবি আছে। আমার জীবনের সেরা বন্ধু ছিল খুকি।’ 

ছোট্ট ড্রয়িং রুমে তার ক্যারিয়ার জুড়ে পাওয়া নানা ট্রফি ও শিল্ড-এর ছবি। এই বয়সে নাতি-নাতনির সঙ্গে পুরনো স্মৃতি আওড়ানোর কথা, অথচ এখন তার দিন কাটে অসুস্থ স্বামী ও সন্তানের সেবায়। দিন-সপ্তাহ ঘুরে মাস ফুরিয়ে এলে নামতে হয় টাকা জোগাড়ের হার্ডেলসে।

এজেড/এটি/জেএস