উৎপল শুভ্র প্রথম আলোতে ফিরলেন কেন?
করোনায় বিপর্যস্ত পৃথিবী যখন নতুন স্বাভাবিকতায় জেগে উঠতে প্রস্তুত হচ্ছিল তখন একটা চমক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। একেবারে নিজের নামে একটা নিউজ আউটলেট, নাম ‘উৎপল শুভ্র ডটকম’। নামটা যখন উৎপল শুভ্র তখন অন্তত আশাবাদী হওয়ার মতো একটা ব্যাপার তো ছিলই। এটা অনেকেরই জানা, তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। দেশ থেকে দেশে, তিন দশকেরও বেশি দীর্ঘ ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সময়ের সেরা তারকাদের। ক্রিকেট ও ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে নিয়ে অলিম্পিক... কাভার করেছেন সবই।
পুরকৌশলে স্নাতক উৎপল শুভ্রর সাংবাদিকতার পথচলা শুরু ১৯৮৯ সালে। তারপর আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ হয়ে প্রথম আলোতে। এরপর গত বছরের ১৫ মার্চ শুরু হয় নতুন অধ্যায়। কিন্তু বছর না পেরোতেই উৎপল শুভ্র ডট কম নামের ওয়েবসাইটের ভবিষ্যৎ অন্ধকার! খোদ উদ্যোক্তা যে ফিরে গেছেন তার পুরোনো ঠিকানায়!
বিজ্ঞাপন
গত ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে উৎপল শুভ্র প্রথম আলোতে পুনরায় যোগ দেওয়ার খবরটি জানান। সেখানে অবশ্য জানাননি কী হবে উৎপল শুভ্র ডটকমের ভবিষ্যৎ কিংবা কেন তিনি ফের ফিরে গেলেন প্রথম আলোয়। দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঢাকা পোস্ট-এর ক্রীড়া সম্পাদক আপন তারিক কথা বলেন উৎপল শুভ্রর সঙ্গে। যেখানে কিছু অপ্রিয় প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন গুণী এই ক্রীড়া সাংবাদিক।
প্রশ্ন: যেখানে দুই দশকেরও বেশি সময় ছিলেন, সেখানে আবার ফিরলেন। লম্বা একটা বিরতির পর। দুই বছর ১০ মাস পর। এত বছরের পুরোনো একটা ঠিকানায় ফেরার অনুভূতিটা কেমন?
বিজ্ঞাপন
উৎপল শুভ্র: এটা আসলে নাটকীয় শোনাবে। তবে আমার মনে হয়নি আমি প্রথম আলোর বাইরে ছিলাম কখনো। ফেসবুকে লিখেছি, আমি প্রচুর ট্যুর করেছি আগে, তখন এক-দুই মাস পর ফেরার যে অনুভূতি হয় সেটাই হয়েছে। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তো আসলে কখনো ছিন্ন হয়নি। এমন হয়নি যে রাগ করে বের হয়ে এসেছি। উল্টো আগের মতো যাওয়া হতো। এটা চাকরির চেয়েও বড়, জীবনের পার্ট ছিল প্রথম আলো। করোনার কারণে এক বছর যাওয়া হয়নি। এর বাইরে খুব কম সপ্তাহ গেছে প্রথম আলোতে যাওয়া হয়নি। আরেকটা ব্যাপার, যেটা অভিভূত করেছে আমাকে, সবার যে ভালোবাসাটা পেয়েছি। যেটা আগে বলেছি, প্রথম আলোর চাকরি ছেড়েছি, প্রথম আলো ছাড়িনি। এটা একদমই অন্য একটা জিনিস, জীবনের অংশ। ফেরার পর যে রিসিপশনটা পেয়েছি- সবকিছু মিলিয়ে এটা ফ্যান্টাসটিক।
প্রশ্ন: আপনি অন্তর্জালে লিখেছিলেন, জীবন আর্ট ফিল্ম না হয়ে থ্রিলার হওয়াই ভালো। তবে সেই থ্রিলারে এত থ্রিল, এত অনিশ্চয়তা থাকাটা মনে হয় একটু বাড়াবাড়িই! মানে আবারও প্রথম আলোতে ফিরবেন এমনটা কি ভেবেছিলেন, যখন আপনার হাতে একটা নতুন প্রজেক্ট?
উৎপল শুভ্র: ‘যেতে পারি’ এটা সবসময় ব্যাক অব দ্য মাইন্ডে ছিল। ইনফ্যাক্ট আমি যদি প্রজেক্ট লঞ্চ না করতাম, তখনই হয়তো জয়েন করতাম। ওটা যখন লঞ্চ হলো, তখন মনে করলাম নতুন জিনিস, চেষ্টা করে দেখি। এটা উপভোগও করছিলাম। এমন না যে ফেইল করছি দেখে চলে গেছি।
প্রশ্ন: আপনি এককভাবে নিজের নামে প্রজেক্টটা শুরু করেছিলেন। যেখানে আপনিই উদ্যেক্তা। এখন আপনিই বলছেন প্রজেক্টটা আপনি উপভোগ করছিলেন। তাহলে এমন কিছু কি আছে, যার কারণে উৎপল শুভ্র ডটকমের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ফিরে গেলেন প্রথম আলোয়?
উৎপল শুভ্র : এনজয় করছিলাম। কিন্তু শেষদিকে জিনিসটা আমার কাছে- প্রথম আলোতে ফেরার সম্ভাবনা অনেক কারণেই জেগেছে। এটার যখন এক বছর পূর্তি হলো, স্পন্সরশিপ রিনিউ, দ্বিতীয় বর্ষে পরিসর আর বাড়ানোর কথা ছিল। অফিস নিতে পারিনি। যখন নরমাল হয়, তখন আবার করোনা আসে। সব মিলিয়ে তখন প্রথম আলোর আলোচনা নতুন করে উঠল। এনজয় করছিলাম ঠিকই, কিন্তু সারাজীবন তো অনেক মানুষের সঙ্গে কাজ করে অভ্যাস। ওটা আমি মিস করতাম। প্রাথমিক উত্তেজনা শেষ যাওয়ার পর নিউজ রুমের ‘ভাইব’টা মিস করা শুরু করলাম। আর প্রথম আলোর বন্ধুদের খুব মিস করতাম। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিস করতাম সম্পাদক মতিউর রহমানকে। চাকরি ছাড়ার পরও সাত-দশ দিন পরপর ওনার সঙ্গে কথা হতো। ওনার তো আগ্রহের শেষ নেই -শিল্প-সাহিত্য-খেলা, কত কী! বন্ধুরা যেমন আড্ডা দেয়, ওনার সঙ্গে আড্ডাই হতো আমার। সবাইকে এত মিস করছিলাম, তখন আমার মনে হলো, ঠিক আছে ফিরে যাই। আমার ওয়েবসাইট তো আছেই, এটা চাইলে শেষ বয়সে আবার করতে পারব।
এসবের বাইরেও আমার একটা ইচ্ছে ছিল উৎপল শুভ্র ডটকম নিয়ে; আমার স্পোর্টস নিয়ে বড় কিছু করার ইচ্ছে ছিল। খেলায় নানা অবিচার নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। খেলার সংস্কৃতি, এসব ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছিলাম। বিকেল হলে মানুষ মনের আনন্দে খেলতে যাবে। স্পোর্টিং নেশন মানে বাংলাদেশ জিতলে রাস্তায় নেমে নাচানাচি করা নয়। স্পোটিং নেশন আমি তাকেই বলব, যাদের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ স্পোর্টিং এক্টিভিটিজ-এ অংশ নেয়। এটা ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল এসব নয়, আমি ফিজিক্যাল একটিভিটিজ-এর কথা বলছিলাম। আমি এই জায়গায় বড় রোল প্লে করতে চাই। আমাদের দেশের মানুষ কতটা ক্রীড়া মনস্ক? এজন্য সামাজিক আন্দোলন করতে চাই সারা দেশে। খোলা মাঠ থাকবে, খেলবে। ভর্তির ব্যাপার থাকবে না। আমি এই জিনিস ছড়াতে চাই। উৎপল শুভ্র ডট কমে যদি সেটা পাঁচ বছরে পারতাম, প্রথম আলোতে এক বছরে পারব। কারণ, এখানকার সারা দেশের সাপোর্ট আলাদা। আমি মনে করি, এটা আমাদের দরকার, আমাদের নেক্সট জেনারেশনকে বাঁচানোর জন্য। এটা করার জন্য প্রথম আলো অনেক বেটার প্লাটফর্ম। আমার মনে হয়েছে সুযোগটা নষ্ট করা উচিত হবে না, তাই প্রথম আলোতে ফিরে এলাম।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনার প্রজেক্ট নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেকেই। একা একজন উদ্যেক্তা হিসেবে শুরুর পর প্রশংসিতও হচ্ছিলেন। এককভাবে যে কিছু করা যায় তা নিয়ে উৎসাহিত হচ্ছিলেন অনেকে। এই যে এখন এভাবে হঠাৎ একটা প্রজেক্টের প্রায় শুরুতেই থমকে গেলেন। কী মনে হচ্ছে, এখন এতে অন্য উদ্যমী কেউ আগ্রহ হারাতে পারেন?
উৎপল শুভ্র: এখানে আমার একটু বলার আছে। এটা তো একটা ইউনিক ব্যাপার ছিল। পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট নেই কারো। আমাকে অনেকে বলেছে, এটাই ফিউচার। আগের মতো বড় বড় মিডিয়া থাকবে না, সবাই নিজের মতো কিছু দাঁড় করাবে। আই এম দ্য মিডিয়া! সেই জায়গা থেকে আমি তাদের বলতে চাই, এটা ব্যর্থতা নয়। আমার কোনো কিছু নিয়ে উৎসাহ বেশিদিন থাকে না, কেন যেন সাংবাদিকতায় থাকল। আমি কাউকে বলব না যে এর ভবিষ্যৎ নেই। কেউ যদি কনফিডেন্ট থাকে, তাহলে সম্ভব। আমি নিজের চেহারা দেখানো এড়িয়ে চলেছি। তারপরও এত বছর কাজ করায় আমার একটা পরিচিতি হয়েছে, এজন্য সহজ ছিল আমার ক্ষেত্রে। অন্য কেউ পরিচিতি তৈরি করে এমন কিছু করলে তার জন্যও সুযোগ আছে। তবে এটা অনেক অ্যাম্বিশাস।
আমার খুব ভালো সাপোর্ট ছিল না। দুটো ছেলেকে পেয়েছিলাম, খুব ভালো- রিজওয়ান রেহমান সাদিদ ও ইমরান আফরাত। এরা না হলে হয়তো ঠিকমতো করতেই পারতাম না। এর বাইরে কারো অলরাউন্ড করার ক্ষমতা থাকলে, সে যেতে পারে।
প্রশ্ন: অপ্রিয় হলেও আপনাকে একটা প্রশ্ন যদি করি.. কেউ যদি বলে লাভের আশায় আপনি আবারো প্রথম আলোতে ফিরে গেছেন, তখন কী বলবেন? যেহেতু উৎপল শুভ্র ডটকমের আপতত কোনো ভালো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছিল না...
উৎপল শুভ্র: আপনি যেহেতু আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তাই উত্তর দেবো। অন্য কেউ বললে হাসব। আমার তো ক্ল্যারিফিকেশনের দরকার নেই। এমন তো নয় যে, উৎপল শুভ্র ডট কম করে লোকজনের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিয়ে আমি পালিয়ে গেছি। ব্যাপারটা তা নয়। পুরো ঘটনা বলার পর যদি মনে হয় আমি লাভের আশায় এটা করেছি, তাহলে আর কী বলব? প্রথম আলোর চেয়ে আর্থিক লাভ আমার কম ছিল না উৎপল শুভ্র ডট কমে। দ্বিতীয় বছরে আমার জন্য আরও সহজ ছিল আয় বাড়ানো।
প্রথম আলো সবসময় আমার মনের মধ্যে ছিল। সেটা, আর আমার শুরুর দিকে যেটা হয়েছে, যারা চাকরি করত তারাও, তখন আফসোস হতো। সবকিছু নরমাল হওয়ার পর আমার আবার ইচ্ছে হলো ‘অফিস’ করতে!
প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় পত্রিকায় কেটেছে। মাঝে কিছুদিন অনলাইন। এখন আবার ফিরলেন প্রিন্টে। প্রথম আলোতে আপনার চ্যালেঞ্জটা কী রকম?
উৎপল শুভ্র: কাজের এরিয়া অনেক বিস্তৃত। অনলাইন স্পোর্টস এডিটর হিসেবে জয়েন করেছি, প্রিন্ট সংস্করণে উপদেষ্টা। ওখানে পরামর্শ থাকবে। স্পোর্টসের বাইরেও প্রথম আলোর নানা বিষয়ে রোল প্লে করার চেষ্টা করব, যতটুকু পারি। শুরুতে স্পোর্টস ঠিক করার চেষ্টা করছি। এখন প্রিন্ট ও অনলাইন একই টিম দুই জায়গায় কাজ করে। আলাদা করা কঠিন। মিলেমিশে সব হয়। এটার সঙ্গে অন্য অনেক ইনিশিয়েটিভ, প্রথম আলোর অন্য অনেক বিষয়- রোলটা মূলত স্পোর্টস, কিন্তু শুধু এখানেই কাজ সীমাবদ্ধ নয়।
প্রশ্ন: তাহলে সহজ করে যদি বলেন আপনার প্রতিষ্ঠিত উৎপল শুভ্র ডটকমের ভবিষ্যৎ আসলে কী? এ অধ্যায় কি শেষ? এখন তো আগের মতো কনটেন্টও দেখা যায় না...
উৎপল শুভ্র: আমি নিজে একটা দায় বোধ করি। যারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, পড়েছেন, ভিডিও দেখেছেন তাদের প্রতি। যেটা পেয়েছি, সেটাও অবিশ্বাস্য। তাদের ব্যাখ্যা করার দায় আছে। তাদের আমি বলব, উৎপল শুভ্র ডট কমে অনেক লেখা আছে, এগুলো চিরকালীন। যে কোনো সময় পড়া যাবে। পুরোনো ইন্টারভিউ মানুষ প্রচুর পড়ে। এটা একটা আর্কাইভ হয়ে থাকল। পাঠকের দরকার কন্টেন্ট, কমার্শিয়ালি চলবে কি না সেই ব্যাপার আমার। আমি ভবিষ্যৎ দেখি, এটাকে আমার আর্কাইভ হিসেবে। আপাতত এটা আমার পার্সোনাল ব্লগ হিসেবে থাকবে। কিছু লেখা থাকবে। ডোমেইনটা রিনিউ করা হয়েছে। মানুষ উৎপল শুভ্র ডট কমে ঢুকলে কনটেন্ট পাবে। শেন ওয়ার্ন মারা গেছেন, অনেকগুলো লেখা আছে। এগুলো তো চিরকালীন। আপাতত বলতে পারেন, জিনিসটা বন্ধ হচ্ছে না। এটা তো দোকান নয় যে বন্ধ হবে।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন- উৎপল শুভ্র ডটকম নাকি প্রথম আলো, ব্যক্তি নাকি প্রতিষ্ঠান কোনটা প্রিয়?
উৎপল শুভ্র: আমার স্বপ্ন ছিল উৎপল শুভ্র ডট কম-কে একটা প্রতিষ্ঠান বানানো। প্রথম আলো ওয়েবসাইটের নাম ‘প্রথম আলো’। ডোমেইনের নাম ডট কম। ঢাকা পোস্টের নাম হচ্ছে ‘ঢাকা পোস্ট ডট কম’। আপনাদের প্রতিষ্ঠানের লোগোতে তো ‘ডট কম’ নেই। আমার এখানে ওয়েবসাইটে ডট কম আছে। আমার একটা ব্যাপার ছিল, ব্যক্তির নামে হলেও ব্যক্তি ছাপিয়ে যেন এটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, নামের মধ্যে ‘ডট কম’ দিলেন কেন? আমি দিয়েছি, এটি ব্যক্তি না হয়ে যেন প্রতিষ্ঠান হয়। এটি প্রথম আলোর চেয়ে বড় হবে এমনটা বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। শুধু আমার লেখা ছাপা হলে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হতো। এখানে অনেকে লিখেছেন। সতেরশ লেখার মধ্যে বেশিরভাগ যদিও আমার; এখানে আমিই ছিলাম মালিক। আর প্রথম আলোকে আমি যতই ভালবাসি না কেন, দিনশেষে এখানে আমি চাকরি করি!
এটি/এমএইচ/এনইউ/জেএস