১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপির) যাত্রা শুরু ফুটবল ও হকি দিয়ে। বিকেএসপির প্রথম হকি ব্যাচের ছাত্র তুষার কান্তি হালদার। ঘরোয়া হকি লিগ খেলেছেন এক দশকের বেশি। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে প্রতিনিধিত্ব করেছেন লাল-সবুজ জার্সিতেও। স্টিক-গ্লাভস তুলে রাখার পর হকি কোচিংয়েও ছিলেন ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এরপর থেকে হকির তুষার চলে যান ক্রিকেটে। গত এক যুগের বেশি সময় বিসিবির ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবে ক্রিকেটার গড়ার কাজ করছেন। 

গোলরক্ষক হিসেবে জাতীয় হকি দলে খুব বেশি দিন খেলা না হলেও ঘরোয়া লিগে উষা ক্রীড়া চক্রের বোর্ড সামলেছেন দীর্ঘদিন। খেলার সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়েছেন সমানতালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা তুষারের রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ব্লু। 

১৯৯৭ সালে হকি না পড়াশোনা এমন দ্বিধার সময়ে পড়াশোনাকেই বেছে নেওয়ার গল্পটা বললেন সাবেক গোলরক্ষক, ‘জাতীয় দলের ইউরোপ সফর ছিল, সেই সময় আবার অনার্স ফাইনালও ছিল। জাতীয় দলের ক্যাম্পে গেলে ইয়ার লস, অনার্স শেষ হতে বিড়ম্বনা। তাই শেষ পর্যন্ত অনার্স শেষ করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম।’ 

খেলার প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি পড়াশোনার দক্ষতা তুষারকে আজকের অবস্থায় এনেছে। ২০০০ সালে ভারতের পাতিয়ালায় হকি ডিপ্লোমা কোচিংয়ে প্রথম হন। সেই কোচিং কোর্স করে এসে বিকেএসপির ক্রীড়া বিজ্ঞানের এক্সারসাইজ ফিজিওলজিতে ভর্তি হন। সেখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই কোর্সই তাকে বছর তিনেক পর ক্রিকেটের দিকে নিয়ে যায়।

২০০৫ সালে বিসিবিতে তুষারকে কাজের প্রথম প্রস্তাব দেন তারই তারই বিকেএসপির সতীর্থ আশফাক বাপ্পি (সাবেক ক্রিকেটার ও মায়ানমার জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ)। দেড় যুগ আগে ক্রিকেটে সম্পৃক্ততা হওয়ার ক্ষণটি তুষার মনে করলেন এভাবে, ‘২০০৫ সালে বাপ্পি ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্টে ছিল।  ডেভলপেমন্টের কোচ থিও পিকেলস দেশীয় ট্রেইনার নিয়োগের চিন্তা-ভাবনা করলে বাপ্পি আমার কথা বলে যেহেতু এক্সারসাইজ ফিজিওলজির উপর আমার ডিগ্রি ছিল। আলাপ-আলোচনায় ও কাজে থিও আমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব  দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার মাধ্যমে থাইল্যান্ডে স্পোর্টস মেডিসিন ও ফিটনেসের উপর দুটো ট্রেনিং করি বিসিবির সহায়তায়। এতে আমিও কাজের আগ্রহ পাই এবং সেও আমার উপর আস্থা পায়।’ 

২০০৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট  নতুন বাঁক নেয়। ক্রিকেট একাডেমি ও ডেভেলপমেন্ট খাতে অনেক কাজ শুরু হয়। ২০০৭-০৮ মৌসুমের দিকে ক্রিকেট বোর্ডে স্থানীয় ট্রেইনার হিসেবে স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করেন তুষার। বিসিবির আগে বিকেএসপিতে স্থায়ী নিয়োগের প্রস্তাব ছিল তার। 

নিজের ক্যাম্পাসের চাকরিতে যোগ না দেয়ার করার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘বিকেএসপিতে হকিতে প্রজেক্ট ভিত্তিক কোচ হিসেবে কাজ করতাম, স্থায়ী ছিলাম না। ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে স্থায়ীভাবে শিক্ষকতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফারুক স্যার (সাবেক পরিচালক বিকেএসপি)। আমি সরাসরি খেলার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। তাই বিকেএসপির শিক্ষকতায় যোগ না দিয়ে বিসিবির সঙ্গে যুক্ত হই।’

জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা অবসরের পর ক্রীড়াঙ্গনে থাকলে কোচ-কর্মকর্তা হয়েই থাকেন বেশি। ফিটনেস ট্রেইনারের দিকে তেমন ঝোঁকেন না। তুষার হকি কোচিং থেকে হঠাৎ অন্য একটি খেলার ফিটনেস ট্রেইনার হয়েছেন। ক্যারিয়ারের গতিপথে অনেকের কাছে ইউটার্নের মতো মনে হলেও তিনি স্বাভাবিকভাবেই দেখেছিলেন, ‘কোচিংয়ের ব্যাপ্তি অনেক বড়। সেখানে ফিটনেস একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি তিনটি খেলার মৌলিক ফিটনেস একই। হকি খেলোয়াড় ও কোচ থাকায় ফিটনেস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল।  স্পেসিফিক কিছু ভিন্ন ফিটনেস রয়েছে খেলাভেদে; সেগুলো কোর্সের মাধ্যমে রপ্ত করেছি।’ 

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রেক্ষাপটে ফিটনেস ট্রেইনারদের সম্মানী ও মর্যাদা অন্যদের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে। বিসিবিতে তুষার সেই জায়গাটি নিজের দক্ষতায় তৈরি করেছেন বলে মনে করেন, ‘আমি সবসময় চেষ্টা করি ক্রিকেটারদের নতুনত্ব ও সেরাটা দেয়ার। আমার কাছ থেকে শিখতে পারায় গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। নিজেকে সব সময় আপডেট রাখার চেষ্টা করি। ২০১৫ ও ১৭ সালে স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনের উপর অস্ট্রেলিয়ান ডিগ্রি নিয়েছি। গত বছর আমেরিকান স্পোর্টস সাইন্স অ্যাসোসিয়েশন থেকেও ডিগ্রি অর্জন করেছি।’

‘কাজের মান ও ডিগ্রি উভয় থাকায় খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা সবার যথেষ্ট সম্মানই পাই। ক্রিকেটারদের অনেকেই বিকেএসপি থেকে এসেছে। বিকেএসপির সিনিয়র ভাই হিসেবেও তারা সমীহ করে আবার জাতীয় হকি দলে খেলেছি এজন্যও আলাদা সম্মান কাজ করে।’  

মুশফিক, সাকিব বাদে সমসাময়িক অন্য ক্রিকেটাররা তুষারের হাতের উপর দিয়েই জাতীয় দলে গিয়েছেন, ‘আমি কাজ শুরু করার আগে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক জাতীয় দলে খেলেছেন। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের ব্যাচ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যারা জাতীয় দলে খেলছে সবাই আমার সরাসরি ফিটনেস ট্রেনিংয়ে ছিল।’ বেশ গর্ব নিয়ে বলেন তুষার। বিসিবি একাডেমির শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন তিনি। 

অ-১৯ দলের সাথে তিনটি বিশ্বকাপ, এ দলের সঙ্গেও ছিলেন অনেক টুর্নামেন্টে । হাইপারফরম্যান্স ইউনিট গঠনের পর থেকে সেখানেই তার মুল দায়িত্ব। এর পাশাপাশি অন্য দলগুলোর সঙ্গেও কাজ করেন এইচপির কর্মসুচি না থাকলে। মাশরাফি, সাকিব,মুশফিকের তৈরির পেছনে ভুমিকা না থাকলেও জাতীয় দলে তাদেরও ট্রেইনিং করিয়েছেন তুষার। 

বাংলাদেশ দল গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ছিল। জাতীয় দলের ট্রেইনার হিসেবে তুষারও ছিলেন সেই সফরে। তবে তার কাজের ও আগ্রহের মুল জায়গা হাই পারফরম্যান্স ইউনিট, ‘আমি কাজ করি হাইপারফরমেন্সে। এটা আসলে ক্রিকেটার তৈরির জায়গা। এখান ফিটনেস ও অন্য বিষয়ে যত সুক্ষ কাজ হবে জাতীয় দলে তত পরিপক্ব ও দক্ষ খেলোয়াড় সরবারহ হবে।’

ভৌগোলিক অবস্থান, খাদ্যাভাস, জিনগত কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অনেকের ফিটনেসে ঘাটতি থাকে। এক যুগের বেশি সময় ক্রিকেটারদের ফিটনেস নিয়ে কাজ করে তার উপলব্ধি, ‘বিসিবিতে কাজ শুরু করার দিকে অনেক ক্রিকেটারদের পেছনে আমার নিজেরই দৌড়াতে হতো। সময়ের পরিক্রমায় এখন ক্রিকেটাররাই উল্টো আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করে লিগ শেষে কয় দিন বিশ্রাম নেব; কবে থেকে কিভাবে ট্রেইনিং শুরু করব।’ 

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেকেই অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েন। এই বিষয়ে সাবেক হকি খেলোয়াড়ের পর্যবেক্ষণ, ‘আসলে ফুটবল এমন একটি খেলা। এর প্রতি প্রায় সবারই সমান আকর্ষণ রয়েছে। ক্রিকেটাররা অনুশীলনের পর ফুটবল খেলার মাধ্যমে ফুরফুরে চাঙা ভাব ফিরে পায়। বেশ আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়েই ফুটবল খেলেন ক্রিকেটাররা। উপভোগ করলেও ফুটবল বডি কনট্যাক্ট গেম; ক্রিকেটে সবার সমান ফিটনেস থাকলেও ফুটবলে কারো কম কারো বেশি। এই ভিন্ন ফিটনেসহীনতা থেকেই মাঝে মধ্যে আঘাত, ইনজুরির সৃষ্টি হয়।’ ১৯৮৬ সালে তুষার নিজেও বিকেএসপিতে প্রথমে ফুটবলে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। ফুটবলে সুযোগ না পেয়ে দুই মাস পর হকিতে ভর্তি হন। 

দীর্ঘদিন ক্রিকেটের সঙ্গে কাজ করায় তুষারের হকির পরিচয় কিছুটা ঢাকা পড়েছে। এর পরও নিজেকে হকি খেলোয়াড় হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য তার, ‘নিজের জন্মকে ভোলা যায় না৷ বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছি, হকি খেলেছি বলেই আজ এ পর্যায়ে এসেছি। হকি আমার পরিচয়,  জীবন-জীবিকা নির্বাহে ক্রিকেটে কাজ করছি। বিসিবির মতো এ রকম সুযোগ ফুটবল, হকিতে থাকলে সেখানেও কাজ করতাম হয়তো।’ 

হকি খেলোয়াড় হয়েও তার হাত ধরে অনেক ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছেন। রিয়াদ,মুমিনুলদের গড়া বিষয়ে তার অনুভূতি, ‘সাকিব-তামিমসহ অনেক ক্রিকেটার প্রায় সময় আমার পরামর্শ ও উপদেশ নেয়। তখন নিজের কাছে বেশ তৃপ্ত মনে হয়। অন্য খেলার হয়েও আমি আরেকটি খেলায় অবদান রাখতে পারছি।’ 

এক দিক থেকে তার যেমন রয়েছে পরিতৃপ্তি তেমনি আরেক দিকে রয়েছে আক্ষেপ। দেশের অন্যতম সেরা ট্রেইনার হয়েও নিজের খেলা হকিকে সেবা দিতে না পারার কষ্ট তার কণ্ঠে, ‘মামুন, আলমগীর রাজু ওরা আমার বন্ধু হিসেবে মাঝে মধ্যে পরামর্শ চায় । ফেডারেশন কখনো আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেইনিংয়ের জন্য চায়নি।’ 

হকি ফেডারেশনের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের দারুণ সম্পর্ক। হকি ফেডারেশনকে অনুদান, বিদেশি কোচের অর্থ দিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। সেখানে হকি ফেডারেশন তুষারকে চাইলেই পেত বলে মনে করেন তিনি, ‘আমাদের সভাপতি পাপন স্যার অত্যন্ত উদার। তিনি অন্য খেলার উন্নয়নেও বিসিবি থেকে অবদান রাখতে চান। সেনাবাহিনীর একটি দল আমার ট্রেইনিং চেয়েছিল। বিসিবি চিঠি পাওয়ার পরই আমাকে সেখানে ট্রেইনিং করানোর অনুমতি দেয়। জাতীয় স্বার্থে হকি ফেডারেশন  চাইলে বিসিবি অবশ্যই সায় দিতো এবং আমিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেতাম।’ 

তুষাররা যখন খেলোয়াড় ছিলেন তখন জনপ্রিয়তায় ও মানে ফুটবলের পরেই ছিল হকি। ক্রিকেট তখন তৃতীয় স্থানে। কালের বিবর্তনে ক্রিকেট এখন সবার আগে, ফুটবল ও হকির অবস্থান পিছিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়তে। নিজের খেলা হকির পিছিয়ে পড়ায় ব্যথিত তিনি, ‘হকিতে একবারই আমাকে একটি সাব কমিটিতে রেখেছিল। আন্তর্জাতিক হকি ফিটনেস ও পাওয়ার নির্ভরতা বাড়ায় হকিতে জিম, ফিটনেস বৃদ্ধির নানা প্রস্তাব রেখেছিলাম এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিজের সহায়তা করার কথাও বলেছিলাম। সেই সব কিছু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ; কাজও হয়নি, সহায়তাও নেয়নি। ক্রিকেটের পাশাপাশি হকিতেও  অপার সম্ভাবনা ছিল বিশ্বকাপে খেলার।’

ক্রিকেট অঙ্গনে তুষার বলতে প্রথমেই সবার ভাবনায় আসে তুষার ইমরান। সেই জাতীয় ক্রিকেটার তুষারও ১৯৯৮ সালে ঢাকায় এসেছিলেন হকি খেলতেই। যশোর হকি লিগ খেলার পর, আবাহনীতে এক মৌসুম ক্লাব কাপ হকি খেলেন। এরপর হকি না খেলে ক্রিকেটেই ক্যারিয়ার গড়েন। আরেকজন তুষার ক্রিকেটার না হয়েও ক্রিকেটার গড়ার পেছনে পর্দার আড়াল থেকে কাজ করছেন। দুই তুষারের মধ্যে দুটো বিষয় বেশ মিল। দুই  তুষারই এখন ক্রিকেটার গড়া কাজ করেন ও একটা সময় উভয়ই হকিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। নানা সীমাবদ্ধতায় দুই তুষারই আজ হকি অঙ্গন থেকে ছিন্ন। এ রকম নানা ছিন্নতায় সম্ভাবনাময় হকি গতিপথ হারিয়ে অস্তগামী। 

এজেড/এমএইচ/এটি