চারটি খেলায় জাতীয় দলের জার্সি পরেছিলেন আখিরুন নেসা। নারী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে এমন কৃত্তিত্ব অন্য কারো নেই। সেই আখিরুননেসা এখন স্বপ্ন দেখেন দুই ছেলেকে জাতীয় ক্রিকেটার বানানোর। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন অবদান রেখেছেন মা হিসেবেও তেমনিভাবে ক্রীড়াঙ্গনে ভূমিকা রাখতে চান সাবেক এই কৃতি ক্রীড়াবিদ। 

আখিরুন নেসার দুই ছেলে। উভয়ই ক্রিকেট খেলেন। বড় ছেলে মাহির আশরাফ টাঙ্গাইল জেলা অনুর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে খেলেছেন। সেখানে ভালো পারফরম্যান্স করে ঢাকা বিভাগের ক্যাম্পেও ছিলেন কয়েক সপ্তাহ। সেই ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে গেলেও জাতীয় দলে খেলার বীজ বপন হয়েছে তাঁর মনে, ‘ঢাকা বিভাগের ক্যাম্পে সামনে আর বাদ পড়তে চাই না। আবার ক্যাম্পে জায়গা করে নিতে নিজেকে প্রমাণ করব। বিভাগীয় দলে খেলে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে খেলব, এরপর একদিন ইন শা আল্লাহ সিনিয়র জাতীয় দলের জার্সি পড়ব।'

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো অনেক ত্যাগ ও নিবেদনের বিষয়। বিশেষ করে বর্তমানে ক্রিকেটে জাতীয় দলে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে জায়গা করে নিতে হয়। নিজে হ্যান্ডবল, কাবাডি, ভলিবল ও অ্যাথলেটিক্স জাতীয় দলে খেলায় বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন আখিরুন, ‘আমার ছেলেরা পরিশ্রম করছে। আশা করি ওরা সফল হবে। একজন ক্রীড়াবিদ মা হিসেবে আমি চাই ছেলেরা জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলুক। আমার সম্পূর্ণ সমর্থন ওদের ওপর রয়েছে।' আখিরুনের স্বামী আশরাফুজ্জামান প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। তিনিও চান তার অপূর্ণতা ছেলেরা পূরণ করুক। 

জাতীয় দলের সহকারী কোচ মিজানুর রহমান বাবুলের সঙ্গে আশরাফুজ্জামানের যোগাযোগ প্রতিনিয়ত। বাবুলের কাছ থেকে ছেলের বিষয়ে সব সময় পরামর্শ নেন৷ মাহির সম্পর্কে বাবুল বলেন,' সরাসরি সে আমার অধীনে খেলেনি। তবে বিভিন্ন কোচের মাধ্যমে শুনেছি সে ভালো ব্যাটিং করে৷ তার বাবা সব সময় ছেলের ব্যাপারে আমাকে অবহিত করে। আমি অনেক সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি, বিশেষত ব্যাটিংয়ের বিষয়ে।' 

মাহির ঢাকা মেট্রো ও টাঙ্গাইল উভয় জায়গা থেকে অনুর্ধ্ব ১৮ জেলা দলে টিকেছিলেন। কোচদের পরামর্শে নিজ জেলা টাঙ্গাইল থেকে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ুয়া মাহির নিজেকে ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। মাহিরের ছোট ভাই ঢাকার মিরপুরে ক্রিকেট চর্চা করছেন। অনুর্ধ্ব ১৬ পর্যায়ে নিজের জায়গা করে নেয়ার লক্ষ্য তাঁর।

আখিরুন হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিক্স, কাবাডি, ভলিবল খেললেও দুই ছেলেই ক্রিকেটের দিকে ঝুকেছেন এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন,‘ আমাদের বাসা একদম মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের লাগোয়া। বাসার ছাদে দাড়িয়েই খেলা দেখা যায়। ছোটবেলা থেকে ওরা এখানে ক্রিকেট দেখে বড় হয়েছে। পাশাপাশি এখন ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাই ওদের টেনেছে’। 

ছেলেদের স্বপ্ন বাড়ির পাশে এই স্টেডিয়ামে একদিন নিজেরা দেশের জার্সি গায়ে খেলবে। এই স্টেডিয়ামে তাদের মা আখিরুন অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে দৌড়েছেন ( আগে মিরপুর স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিক্স হতো)। ১৯৮৬ সালে হ্যান্ডবল দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন আখিরুনকে মনে রাখবে বর্ষা নিক্ষেপকারী হিসেবে। কয়েকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে জ্যাভলিন থ্রোতে চ্যাম্পিয়ন আখিরুনের গড়া রেকর্ড এখনো দুই দশকের বেশি সময় ধরে অক্ষুণ্ন।  

অ্যাথলেটিকসে দারুণ সফল হলেও দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে আখিরুনের অভিষেক ভলিবলে। ১৯৯১ কলম্বো ও '৯৩ ঢাকা সাফ গেমসে বাংলাদেশ নারী ভলিবল দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আখিরুন। '৯৫ সালের মাদ্রাজ সাফ গেমস আবার খেলেছেন জ্যাভলিন থ্রোয়ার হিসেবে। হ্যান্ডবল দলের হয়ে কয়েকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন। কাবাডি দলের হয়েও বিদেশ সফর করেছেন। চারটি খেলার জাতীয় দল ও বিদেশের মাটিতে প্রতিনিধিত্ব করার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী আখিরুন নিজেকে জ্যাভলিন স্পেশালিস্ট হিসেবেই আলাদা করলেন, ‘আমি অনেক খেলা খেললেও অ্যাথলেট হিসেবেই সবাই চেনে। জ্যাভলিন আমার স্বতন্ত্র ইভেন্ট বাকিগুলো দলীয়।' 

সত্তরের দশকে বশীর আহমেদ, ইব্রাহিম সাবের, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা সহ আরো কয়েকজন তিন-চারটি ডিসিপ্লিনে ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনে অংশ নিতেন। এদের মধ্যে বশীর আহমেদ ও ইব্রাহিম সাবের উভয়ই তিনটির বেশি ডিসিপ্লিনে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে একজন নারী চারটি ডিসিপ্লিনে জাতীয় জার্সি পড়েও আলোচনার বাইরে, 'আমি খেলা, সংসার, পরিবার সব কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেললেও নারী দলের তেমন সাফল্য ছিল না এবং খেলাও কম ছিল এজন্য প্রচার কম হয়েছে ' মনে করেন আখিরুন৷ 

১৯৯৬ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আখিরুন। কয়েক বছর পর মা হন। মা হওয়ার পর সংগ্রাম সম্পর্কে এই নারী ক্রীড়াবিদ বলেন,' বিজেএমসিতে আমাদের ক্যাম্প হতো। সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে থাকতাম মাঝে মধ্যে। মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় অনেক সময় আমার জন্য আলাদা রুম ছিল। পরিবার ও ক্রীড়াঙ্গন উভয় জায়গা থেকে সহায়তা পেয়েছি। খেলার মাঠে যেমন সময় দিয়েছি, তেমনি বাসার কাজও আমিই করেছি। '

২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে ভলিবল থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর নিয়েছেন। অন্য খেলাগুলো থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর না নিলেও আর খেলেননি। খেলা ছাড়ার পর বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনে ( বিজেএমসি) হ্যান্ডবল দলের কোচ ছিলেন। সাফে হ্যান্ডবল খেলা না হলেও ২০১৬ সালে গৌহাটি এসএ গেমসে হ্যান্ডবল দলের কোচ ছিলেন। প্রায় দুই বছর ধরে বিজেএমসি ক্রীড়া খাত বন্ধ। বিজেএমসির খেলোয়াড়রা অন্য সার্ভিসেসের খেলায় নিজেদের ঠিকানা খুজে নিলেও আখিরুন এখনো বিজেএমসিতে আছেন,' আমার চাকরি স্থায়ী। আমি মতিঝিলে অফিস করি সপ্তাহে পাঁচ দিন। অফিস, বাসা ও ছেলেদের দেখাশোনায় সময় কেটে যায় আমার। '

এজেড/এইচএমএ