রাঙামাটি থেকে উঠে আসা সুর কৃষ্ণ চাকমা এখন দেশের বক্সিংয়ের আইকন। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কয়েকবার। দেশের একমাত্র স্বীকৃত পেশাদার বক্সার। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম পেশাদার বক্সিংয়ে হয়েছেন সেরা। বাংলাদেশের এই সেরা বক্সার নিজের সংগ্রামী জীবন, বক্সিংয়ের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনাসহ নানা বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরকে।

তরুণরা সাধারণত ক্রিকেট, ফুটবল ও অন্য জনপ্রিয় খেলাগুলোতে যেতে চায়। আপনার বক্সিংয়ে আসার গল্পটা কী রকম?

ফুটবলটা আমার বেশ পছন্দের খেলা। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার। বিকেএসপিতে ফুটবলার হতে পরীক্ষা দিয়েছি। উচ্চতা কিছুটা কম থাকায় সেখানে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারিনি। ফুটবলের পাশাপাশি বক্সিংও আমার ভালো লাগত। এই খেলাটি আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চ দিত। ফুটবলে যখন বিকেএসপিতে টিকলাম না তখন বক্সিংয়ে পরীক্ষা দিলাম এবং হয়েও গেল। 

বিকেএসপির সূত্রেই আপনার বক্সিংয়ে আসা। এখন আপনি বাংলাদেশের বক্সিংয়ের অন্যতম তারকা এবং আইকন হয়ে উঠেছেন। বিষয়টি কেমন লাগে?

বক্সিংয়ে যখন বিকেএসপিতে ছিলাম তখনই ইচ্ছে ছিল দেশের শীর্ষ খেলোয়াড় হব। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। খেলার প্রতি ভালোবাসা যেমন রয়েছে এর পাশাপাশি চেষ্টা। এই দুই মিলিয়েই হয়তো আমার এই অবস্থান। জুনিয়ররা যখন অনুসরণ করে তখন ভালো লাগে। অন্য খেলার খেলোয়াড়রাও যখন অভিনন্দন এবং খেলার ব্যাপার জানতে চায় তখনও দারুণ লাগে।

আদিবাসী হয়েও বক্সিংয়ে আপনার স্বাতন্ত্র্যতা তৈরিতে বেশ চ্যালেঞ্জই ছিল নিশ্চয়ই-

যে কোনো ক্ষেত্রে কষ্ট করেই প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। আমাদের শারীরিক সামর্থ্যতা একটু বেশি সেটা এই খেলায় সাহায্যই করেছে। পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয়ে অনেক চড়াই-উতরাই থাকলেও বক্সিং বা ক্রীড়াঙ্গনের কেউ আমাকে কখনো জাতিগত অবজ্ঞা করেনি। সবার মধ্যেই আন্তরিকতা ছিল। 

আপনাকে অনুসরণ করে একটি প্রজন্ম বক্সিংয়ে আসছে ও শিখছে। আপনি কাকে অনুসরণ করেছেন?

বাংলাদেশে মোশাররফ স্যারের কথা অনেক শুনেছি। দুভার্গ্য সেই সময় তাদের খেলার ফুটেজ সেভাবে নেই। রহিম ভাই, আল আমিন ভাই আমার সিনিয়র খেলোয়াড়। তাদের কাছ থেকে টিপস নিয়েছি নানা সময়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রুসলিকে আমার বেশি অনুসরণ করা হয়েছে।

মহাদেশীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম পদক কিন্তু বক্সিং থেকেই আসে। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে মোশাররফ হোসেন ব্রোঞ্জ জেতেন। এর পর তিন যুগ চলছে এশিয়ানে কোনো পদক নেই। এর কারণ কি এবং আদৌ সম্ভব কিনা..

মোশাররফ স্যার অত্যন্ত উচু মানের বক্সার। পরবর্তী প্রজন্মের যারা বক্সার ছিলেন তাদের ও ফেডারেশনের হয়তো লক্ষ্যই ছিল দক্ষিণ এশিয়া বা সাফ গন্ডিতে। দৃষ্টিসীমা বড় করে যদি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অনুশীলন করা যায় তাহলে পুনরায় এশিয়ানে পদক পাওয়া অসম্ভব কিছু না। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও এর সঠিক বাস্তবায়ন।

আপনি কয়েক বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। বক্সিং অঙ্গনের সবাই আপনাকে চিনত। কিন্তু সম্প্রতি পেশাদার বক্সিংয়ে সেরা হওয়ার পরই আপনার তারকা খ্যাতি ক্রীড়াঙ্গনের গন্ডি ছড়িয়ে সামাজিক অঙ্গনেও বিস্তৃতি হয়েছে...

আসলে প্রথম যে কোনো কিছুই বড় উন্মাদনার। বাংলাদেশে এবারই প্রথম পেশাদার বক্সিং হলো। তাই আকর্ষণটা বেশি ছিল। ক্রীড়াঙ্গন তো বটেই এর বাইরেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও নানা অঙ্গনের মানুষ শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আগে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ আমাকে চিনতো, এখন অন্য অঙ্গনের মানুষরাও চিনবে।

বিকেএসপিতে ডিসিপ্লিনের শীর্ষ খেলোয়াড় ছিলেন এখন দেশের সেরাদের একজন আপনি। বিকেএসপিতে আপনাদের একই ব্যাচে থাকা ফুটবল, ক্রিকেট, হকির অনেক মিডিওকার খেলোয়াড়ের পরিচিতি ও অর্থ দুটোই আপনার চেয়ে বেশি। এটি কি আপনাকে  অনুশোচনায় ভোগায়?

বিকেএসপিতে আসলে কোনো ভেদাভেদ নেই। সাকিব ভাই আমাদের সিনিয়র ছিলেন, তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার কিন্তু আমাদের কাছে সেই সাকিব ভাই-ই। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও কে কোন খেলার এ নিয়ে বিশেষ কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। অর্থ ও অবস্থান নিয়ে আমার নেই কোনো অনুশোচনাও। আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। বিধাতা যেটা ভালো করেছেন সেটাই দিয়েছেন। অন্য খেলায় বা অন্য কিছুতে গেলে হয়তো অর্থ বেশি পেতাম, হয়তো আজকের এই সুর কৃষ্ণ হতে পারতাম না। বিধাতা হয়তো বক্সিংয়ের সুর কৃষ্ণই হিসেবে লিখে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আনসারের ভাতাপ্রাপ্ত খেলোয়াড় আমি। মাসিক বিশ হাজারের মতো অর্থ পাই এবং আনুষাঙ্গিক কিছু আয়ও রয়েছে। আমি সব সময় নিজের বিদ্যমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকি এবং সতীর্থদের সাফল্যে আনন্দিত হই।

সাকিবের সঙ্গে আপনার তো একটি মিল রয়েছে-

কোনটি (কিছুক্ষণ থেমে), ওহ নিষেধাজ্ঞা (হাসি)। আমিও ফেডারেশন থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলাম।

ক্রিকেটে সাকিব, হকিতে জিমি, ফুটবলে মামুনুল ও বক্সিংয়ে আপনি স্ব স্ব খেলায় দেশের সেরা। বিকেএসপিতে আপনারা খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করতেন। পরবর্তীতে আপনারা চারজনই শৃঙ্খলাজনিত কারণে বিভিন্ন সময়ে ফেডারেশনের শাস্তির মুখে পড়েছেন-

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাকিব ভাই, জিমি ভাই ও মামুনুল ভাই অনেক বড় মাপের খেলোয়াড় ও ব্যক্তিত্ব। তাদের বিষয়গুলো ফেডারেশন ছাপিয়ে জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় মাঝেমধ্যে। আমি অনেক অনুজ হয়ে এসব ব্যাপারে মন্তব্য করা অনুচিৎ। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে পারি, প্রতিটি ফেডারেশনের সেই খেলার শীর্ষ ২-৩ জন খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়মিতভাবে আলাদাভাবে মাঝেমধ্যে বসা উচিত। তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে অনেক দূরত্বই কমে আসে। আমাকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল (ফেডারেশনের অনুমতি ছাড়া বাইরে প্রশিক্ষণে যাওয়ায়)। আমি কখনোই ভেঙে পড়িনি। আমি অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছিলাম পাশাপাশি পড়াশোনাও করেছি। এক পর্যায়ে ফেডারেশন আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, আবার স্বরূপেই ফিরি।

ফেডারেশনের প্রতিযোগিতা তো অ্যামেচার বক্সিং। নিজেকে পেশাদার বক্সার হিসেবে প্রস্তুত করলেন কিভাবে?

পেশাদার বক্সার হিসেবে আমার স্বপ্নের বীজ বপন হয় ২০১৮ সালে। আলি জ্যাকোর সঙ্গে লন্ডনে পেশাদার বক্সিং দেখি। সেখানে প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণ করি। তখন আসলে বুঝতে পারি পেশাদার বক্সিংয়ের জগতটা কত বড়। হাজার হাজার কোটি টাকার পুরস্কার ও টুর্নামেন্ট। তখন থেকেই নিজেকে পেশাদার বক্সিংয়ের জন্য তৈরি করতে শুরু করি। ভারতেও গিয়েছি কিছু টুর্নামেন্ট খেলেছি। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পেশাদার বক্সিং শুরু করার সময় এসেছে কিনা?

অবশ্যই এসেছে। আদনান হারুন ভাইকে ধন্যবাদ যিনি এই উদ্যোগ নিয়ে পেশাদার বক্সিংয়ের যাত্রা শুরু করেছেন। আশা করি সামনে এর ধারাবাহিকতা থাকবে এবং এর ব্যপ্তিও বাড়বে ধীরে ধীরে। 

পেশাদার বক্সিংয়ে আর্থিক সুবিধা যেমন আছে, ঝুঁকিও আছে অনেক...

জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যায়। প্রায় প্রতি কাজেই ঝুঁকি থাকে। অ্যামেচার বক্সিংয়ের তুলনায় পেশাদার বক্সিংয়ে একটু ঝুকি থাকবে স্বাভাবিক। এখানে প্রটেকশন কম এবং ফাইট বেশি। বক্সিং এক প্রকার জীবন। বক্সিংয়ের রিংই জীবন বলা যায়। জীবনে বাঁচতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। কখনো লড়তে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে আবার শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে। কখনো রক্ষণ করছে আবার কখনো আক্রমণ করে বিজয়ের হাসি হাসছে। 

তাহলে এই বক্সিংয়ের মাধ্যমে আপনি জীবনের দর্শন খুঁজে পান?

অবশ্যই। বক্সিংয়ে আসার পর আমার জীবনেরও অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে অনেক সিদ্ধান্ত বা অনেক কিছুতে হুটহাট মন খারাপ বা অন্য রকম প্রতিক্রিয়া থাকত। এখন ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর পেছনে বক্সিংই কারণ। অন্য সব খেলার তুলনায় বক্সিংয়ে একজন বক্সার এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ব্যাকফুটে গিয়ে ডিফেন্স করবে না অন্য হাত দিয়ে আক্রমণ করবে। 

খেলাধূলার পাশাপাশি তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষাও নিয়েছেন... 

আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বিকেএসপি থেকে বের হয়ে আমার সেই চেষ্টাই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও আমাকে একজন প্রকৃত বক্সার এবং খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতে সহায়তা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফলে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলো আমি অর্জন করতে পেরেছি। যা একজন খেলোয়াড়ের অবশ্যই প্রয়োজন। 

আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে। এই বিষয়টি আপনার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে অনেকটা বিপরীত অবস্থানে। এটি মানিয়ে নিলেন কিভাবে?

আসলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছি। বিকেএসপির খেলোয়াড় কোটার মাধ্যমে আমাকে এই বিভাগে ভর্তি করে। বিষয় নিয়ে আমার মধ্যে কখনো অস্বস্তি কাজ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমি উপভোগ করেছি, জগন্নাথ হল, ক্যাম্পাস উপভোগ করতে করতেই আমার একাডেমিক পড়াশোনাও শেষ হয়ে গেছে। 

পড়াশোনা শেষ, খেলায় এখন আপনি ভালো পর্যায়ে থাকলেও এক সময় ইতি টানতে হবে। এরপরের পরিকল্পনা কি?

আমার খেলার শিকড় বিকেএসপিতে। আমি চাইব বক্সিং ও খেলাধূলার সঙ্গেই থাকতে। খেলার পর কোচিং করানোর পরিকল্পনাটাই বেশি।

আপনি রাঙামাটিতে বেড়ে উঠেছেন। পাহাড়ি অঞ্চলে তো বক্সিংয়ের তেমন সুযোগ সুবিধা নেই। নিজ জেলার জন্য কিছু করবেন না...

আমার পরিবারটা ক্রীড়াপ্রেমী। আমার বাবা চট্টগ্রাম ফুটবল লিগে খেলছে। আত্মীয় স্বজনরা অনেকেই অনেক খেলায় জড়িত ছিল। শুধু আমাদের রাঙামাটি কেন ঢাকার বাইরে রাজশাহী ছাড়া তেমন কোথাও বক্সিংয়ের রিং নেই। আমার ইচ্ছে আছে রাঙামাটিতে একটি বক্সিং একাডেমি করার।

ক্রীড়া ও শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এমন আদিবাসীর সংখ্যা খুব কম ক্রীড়াঙ্গনে। আপনার ওপর আপনার জনগোষ্ঠীর বাড়তি প্রত্যাশা রয়েছে নিশ্চয়ই? 

রাঙামাটিতে আমাকে ও জয়া দি'কে (প্রথম ফিফা নারী রেফারি) নিয়ে সবাই গর্বিত। আমরা দুই জনই চাই আমাদের জনগোষ্ঠীর আরও লোকজন খেলাধুলায় আসুক। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের জনগোষ্ঠীর আরও অনেক কিছু দেওয়ার সামর্থ্য ও সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সুযোগ ও ক্ষেত্র। আমরা একটি অবস্থানে পৌঁছানোয় পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

এজেড/এটি