ক্যারম শহর ও গ্রাম বাংলার বেশ প্রচলিত এক খেলা। ছোট্ট এক জায়গা বোর্ড ফেলে গুটি ফেলার আনন্দ উপভোগ জনজীবনের খুব সাধারণ এক চিত্র। এই খেলার জনপ্রিয়তা যেমন আছে, তেমনি এই খেলাটি এক প্রকার নেশা ও বাজি-জুয়া নির্ভর এ রকম কটুক্তিও রয়েছে। পারিবারিক আবহে নারী-পুরুষ একত্রে ক্যারম খেললেও পেশাদারভাবে ক্যারমে নারীর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোণা। 

গত দুই যুগে শখের বশে ও ভালোবেসে ক্যারম ফেডারেশনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন অনেক নারী। সময়ের পরিক্রমায় তারা ক্যারমের সঙ্গে আর সেভাবে থাকেননি। বিয়ে, সংসার ও পেশাগত কারণে ক্যারমের গুটি-বোর্ডের সঙ্গে তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শামসুন্নাহার মাকসুদা। ২০০০ সাল থেকে ক্যারমের বোর্ড ও গুটির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ক্যারমের প্রতি তার টান কমেনি একটুও, বরং আরো বেড়েছে।

সংসার ও পেশাগত জীবনের ব্যস্ততা বাড়লেও ক্যারম থেকে দূরে সরেননি মাকসুদা। ২০০৫ সালে ২৪ তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেছিলেন মাকসুদা। বেশ কয়েকটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করে এখন কিশোরগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। একটি জেলার শিক্ষা অফিসারের মতো গুরুত্ব দায়িত্বে থেকেও ক্যারমের জন্য সময় দেন। 

মাহমুদার অতি সম্প্রতি নিবেদনের উদাহরণ দিলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আহমেদ লিয়ন বলেন, ‘আমাদের সামার হিট টুর্নামেন্টে অংশ নিতে শুক্রবার ভোরে কিশোরগঞ্জ থেকে গাড়িতে রওনা হয়েছিলেন। সকালে ফেডারেশনে পৌঁছে সারা দিন খেলে রাত নয়টা আবার গাড়িতে কিশোরগঞ্জ রওনা হয়েছেন। পরের দিন অফিস করেছেন। এ রকম তো সবাই করবে না।’ 

কিশোরগঞ্জে জেলা শিক্ষা অফিসারের আগে জামালপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন কয়েক বছর। তখনও এই রকম ঝক্কি বহন করেছেন। যাতায়াতের এই কষ্ট অবশ্য এখন সয়ে গেছে তার, ‘খেলা হয় ঢাকায়, আর আমার পোস্টিং বিভিন্ন জেলায়। ঢাকায় টুর্নামেন্ট খেলতে আসতে হলে তো এ রকম কষ্ট করতেই হবে। ক্যারমকে ভালোবাসি, তাই কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না।’

শুধু অংশগ্রহণের জন্য অংশগ্রহণ নয়; বেশ দাপটের সঙ্গেই টুর্নামেন্ট খেলেন মাকসুদা। দুই দিন আগে শেষ হওয়া সামার হিটে নারী এককে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বর্তমান জাতীয় ক্যারম নারী চ্যাম্পিয়নও তিনি (সর্বশেষ ২০১৯ সালে জাতীয় ক্যারম হয়েছিল)। বিজয় দিবস সহ নানা টুর্নামেন্টে শিরোপা অর্জনের কৃতিত্ব রয়েছে তার। 

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পদক রয়েছে , ‘২০০০ সালে ভারতে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মিশ্র ইভেন্টে কবীর ভাইয়ের সঙ্গে ব্রোঞ্জ পদক রয়েছে আমার। গত দুই দশকে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছি’-বেশ গর্ব সহকারে বলছিলেন মাকসুদা। 

অন্য খেলাগুলোতে যতটা প্রচার রয়েছে, এই খেলায় নেই এ নিয়ে খানিকটা আক্ষেপও ঝরল তার কণ্ঠে, ‘আমি একটা খেলার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, সেভাবে মানুষ জানে না। বিষয়টি ভাবলে একটু খারাপ লাগে মাঝে মধ্যে।’

যে কোনো খেলায় অনুশীলন নির্ভর। অনুশীলন ছাড়া সাফল্য আসে না। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর পারিবারিক কাজ। শিক্ষক স্বামী ও দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে এই ক্যারম চ্যাম্পিয়নের পরিবার। সারা দিনের নানা ব্যস্ততার মধ্যে কিছু সময় বোর্ডে দেন, ‘প্রতি দিন কিছু সময় খেলার চেষ্টা করি। আমার ছোট ছেলেটার ক্যারমের প্রতি ঝোঁক আছে। ওর সঙ্গেও খেলি মাঝে মধ্যে। আর টুর্নামেন্ট আসলে তখন দিনে তিন-চার ঘণ্টা অনুশীলনও করি।’ 

প্রচলিত ক্যারমের সঙ্গে পেশাদার ক্যারমের ভিন্নতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্যারম হয় ছোট বোর্ডে এবং বসে খেলতে হয়, গুটি বেশ ভারী। অনুশীলনের সুবিধার্থে এ সব কিছুর ব্যবস্থা বাসাতেই রয়েছে তার।

ক্যারমে বিশেষ অবস্থান করা এবং এখনো খেলা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে স্বামী ও পরিবারকে যথেষ্ট অবদান দিলেন, ‘২০০০ সালে যখন খেলা শুরু করি তখন বাবা-মা সহায়তা করেছে। বিয়ে হওয়ার পর স্বামী যথেষ্ট সাহায্য করেছে। না হলে তো আর খেলতে পারতাম না।’ 

নিজে খেলছেন পাশাপাশি চেষ্টা করছেন নারীদেরও খেলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার, ‘যখন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলাম তখন ক্যারম ইভেন্ট রাখতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যারম যে খারাপ কিছু নয়, সুন্দর ভালো একটি খেলা সেই বার্তাও দিতাম। বর্তমানে পড়াশোনার এত চাপ ও অভিভাবকরা খেলায় দিয়ে সন্তানদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে চান না। এজন্য আসলে পেশাদার পর্যায়ে খেলোয়াড় সেভাবে আসছে না।’ 

নারী ক্যারম খেলোয়াড়ের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকও, ‘জাতীয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ১০-১৫ জনের বেশি নারী প্রতিযোগী আমাদের হয় না। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আসলেও পরবর্তী পেশায় যোগ দিয়ে অথবা বিয়ের পর আর খেলায় আগ্রহী হয় না।’ 

নারী খেলোয়াড় বৃদ্ধি করতে বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে ফেডারেশনের, ‘ক্যারম নারীবান্ধব এক খেলা। আমরা ইডেন কলেজে বিশেষভাবে চিঠি দিয়েছি ক্যারম আয়োজন করার। আমরা সর্বাত্মক সহায়তা করব। এর পাশাপাশি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্যারম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খেলোয়াড় সৃষ্টি করার পরিকল্পনা আছে’-বলেন সাধারণ সম্পাদক। 

নারীদের খেলার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশ। ক্যারম ফেডারেশন হকি স্টেডিয়ামের এক কোণায় ছোট্ট একটি রুম থেকে পরিচালিত হয়। এমন পরিবেশে অনেক নারী এসে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কর্মজীবী নারীদের নিয়ে তাই ভালো কোনো জায়গায় টুর্নামেন্ট করার ভাবনা রয়েছে ফেডারেশনের।  

গত ২২ বছরে বাংলাদেশের ক্যারম ও নারী খেলোয়াড়দের আসা-যাওয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাকসুদা। দুই দশকের পথ চলায় তার উপলব্ধি, ‘নারী খেলোয়াড় সংখ্যা কমলেও আগের তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। খেলার প্রসারে নারীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ও পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে ভালো কিছু সম্ভব। সেক্ষেত্রে কয়েক মাস ব্যাপী অনুশীলন প্রয়োজন। আমরা অল্প ক’দিনের অনুশীলন নিয়ে খেলতে যাই।’ 

তিন সন্তানের জননী ও জাতীয় ক্যারম চ্যাম্পিয়ন মাকসুদার বয়স ৪৫ এর কাছাকাছি। শারীরিক সামর্থ্য থাকা পর্যন্ত খেলে যেতে চান বর্তমান জাতীয় নারী চ্যাম্পিয়ন, ‘খেলাধূলায় বয়স অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। ক্যারমে হাতের নার্ভ খুব শক্ত থাকতে হয়। হাত যত দিন কাঁপবে না তত দিন খেলার ইচ্ছে।’

এজেড/এনইউ