উপমহাদেশে দাবায় প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। বাংলাদেশে দাবার কোচিংয়েও তিনি অগ্রদূত। নিয়াজকে দেখেই দেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান কোচিংয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের এই দুই গ্র্যান্ডমাস্টারের ছয় শিষ্য এখন গ্র্যান্ডমাস্টার ৷ ছয় জনই ভারতীয়, এর মধ্যে পাঁচ জন পুরুষ, একজন নারী। 

নিয়াজ শুরুতে কোচিং শুরু করলেও এতে বেশি থিতু হননি। জিয়া ২০০৯ সালে শুরু করে এখন পর্যন্ত নিয়মিতভাবে কোচিং করিয়ে যাচ্ছেন। এক নাগাড়ে এত দিন কোচিং করানোয় নিয়াজের তুলনায় তার শিষ্য গ্র্যান্ডমাস্টার দ্বিগুণ। নিয়াজের কোচিংয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন সাহেলী রোবান ও কিরণ মনীষা মোহন্তি। যিনি উড়িষ্যার প্রথম নারী জিএম। জিয়ার কোচিং করানোর পর জিএম হওয়া চার জনের দুই জন কলকাতার আর দু’জন পুনের। 

কলকাতার দাবাড়ু মিত্রভা গুহ তার জিএম হওয়ার পেছনে জিয়ার অবদান বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘জিয়া স্যারের বাসায় আমি ২০১৬ সালে কিছু দিন কোচিং করেছি। বিশেষ করে স্যারের কাছ থেকে ওপেনিং শিখেছি। স্যারের কোর্স করার পর অনেক উন্নতি হয়েছে।’ কলকাতার আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার দীপ্তায়ন ঘোষও গুরু মানেন জিয়াকে, ‘জিয়া স্যারের অধীনে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক বার কোর্স করেছি। কখনো তিনি ভারত এসে করিয়েছেন আবার কখনো আমিও গিয়েছি। আমার জিএম হওয়ার পেছনে স্যারের কোচিংয়ের অবদান রয়েছে।’

ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গ্র্যান্ডমাস্টার। এরপরও ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে জিয়ার কাছে কোচিং করার কারণ সম্পর্কে মিত্রভা বলেন, ‘কলকাতা থেকে দিল্লি, চেন্নাইয়ের দূরত্ব অনেক। সময় যেমন লাগে, খরচও আছে। এর চেয়ে অল্প খরচে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা যায়।’

দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ দেশের বাইরে ভারতে বেশি কোচিং করিয়েছেন। বিভিন্ন প্রদেশের তুলনায় কলকাতা ও চেন্নাইয়ে ভালো দাবাড়ু আছে বলে মনে করেন নিয়াজ, ‘জিয়া এখন কলকাতা অঞ্চলে কোচিং করাচ্ছে। সেখানে মেধাবী দাবাড়ু এবং জিএম হওয়ার হারও বেশি। আমি কোচিংকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে করিনি। মাঝে মধ্যে করিয়েছি। যে দু'জন জিএম হয়েছে তাদের ভারতে গিয়েই কোচিং করিয়েছি কয়েকবার।’

জিয়াও দেশের বাইরে গিয়ে কোচিং করান। একবার মালয়েশিয়া জাতীয় দলেরও কোচ ছিলেন। তবে তার মূল কোচিংটা মোহাম্মদপুরে নিজের বাসায়। যেখান থেকে ভবিষ্যত জিএম তৈরি করছেন। জিয়ার মোহাম্মদপুরের বাসায় একটি আলাদা রুমই রয়েছে বিদেশি প্রশিক্ষণার্থী দাবাড়ুদের জন্য। বিদেশিরা জিয়ার বাসায় এসে থেকেই কোর্স করেন। বাসায় বিদেশি লোকের বসবাস অনেক পরিবারই সহজভাবে নেবে না। জিয়ার স্ত্রী লাবণ্য যিনি স্বামীর জন্য বিসিএস ক্যাডার হয়েও যোগ দেননি তার জন্য তো এটি আর বেশি কিছু না, ‘আসলে আমার স্ত্রী ও সন্তানের জন্যই এটা সম্ভব। তারা আমাকে অনেক সমর্থন করে। এজন্যই এভাবে কোচিং করানো সম্ভব।’ বেশ তৃপ্তি নিয়ে বলেন জিয়া। 

২০০৯-১০ সালের দিকে কোচিং শুরু করেন দেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। খেলার পাশাপাশি কোচিংয়ে আসার পেছনেও পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিলেন নিয়াজ মোর্শেদ, ‘আসলে নিয়াজ ভাইকে দেখেই কোচিংয়ে আসা। নিয়াজ ভাই কোচিং করাতেন। তখন ভাবলাম, খেলার পাশাপাশি এটাও একটা ভালো মাধ্যম।’

কোচিং জিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস। এরপরও কোচ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে একটু কাপর্ণ্য তাঁর, ‘খেলাটাই আমার আসল। কোচিংটা পরে, খেলা আগে। বছরে খেলার ফাঁকে কয়েক মাস কোচিং করি। কোচিংয়ের জন্য অনেক সময় খেলায় প্রভাব পড়ে।’ কোচদের আয় সম্পর্কে নিয়াজের বক্তব্য, ‘কেউ যদি পুরোদস্তুর কোচিং করায় তাহলে অনেক আয়। ভারতে কয়েকজন আছেন তারা আর খেলেন না শুধু কোচিং করান। তাদের আয় খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি।’

নিয়াজ মোর্শেদ অবশ্য এখন কোচিং থেকে দূরে। কোচিং বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে বলেন, ‘কোচিং করাতে এক নাগাড়ে অনেক সময় দিতে হয়। এজন্য আর এটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নিজে খেলতে ৬-৭ ঘণ্টা সময় দেয়া সমস্যা নয়, কিন্তু কোচিংয়ে এক নাগাড়ে কয়েকঘণ্টা দেয়া কষ্টকর।’ বাংলাদেশের প্রতিভাবান দাবাড়ু ফাহাদ রহমান নিয়াজেরই শিষ্য। এখনও মাঝে মধ্যে ফাহাদের সেশন নেন নিয়াজ। 

জিয়া দেশি, বিদেশি দাবাড়ুদের নিজ বাসায় কোচিং করান। অনলাইনে দাবা শেখান অস্ট্রেলিয়ান, ইউরোপীয়ানদেরও। ছাত্র-শিক্ষক যোগাযোগের মাধ্যম সম্পর্কে জিয়া বলেন, ‘দাবায় কোচদের জন্য আলাদা সেভাবে সনদ আগে ছিল না। জিএমরাই সারা বিশ্বে প্রশিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত। দাবার ওয়েবসাইটে শিক্ষকদের প্রোফাইল ও সময় দেয়া থাকে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো কোচের সাথে যোগাযোগ করেন।’

এক যুগের ব্যবধানে জিয়া কোচ হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিতই। তার কোচিংয়ে চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার। যেখানে বাংলাদেশে গ্র্যান্ডমাস্টার সংখ্যা পাঁচ জন।

এই বিষয়ে জিয়ার মিশ্র প্রতিক্রিয়া, ‘খুব ভালো লাগে যখন আমার কোচিং করা কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার হয়। পাশাপাশি একটু খারাপও লাগে। ওরা আমার পর্যায়ে উঠে আসল। সেই হিসেবে আমার আরো বেশি ওপরে যাওয়ার কথা ছিল।’ ব্যক্তিগত জায়গার পাশাপাশি দেশের দৃষ্টিকোণ থেকেও আক্ষেপ রয়েছে এই দাবাড়ু কাম কোচের, ‘ভারতের একজন দাবাড়ু অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পর ভুল ত্রুটিগুলো কোচিংয়ে শুধরে আবার আরেক প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে। সেখানে কাঙ্খিত নর্ম অর্জন করে জিএমের দিকে ধাবিত হয়।’ 

উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার কোচিংয়ের চেয়ে খেলাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ‘আমি যখন জিএম হয়েছি, কোনো কোচ ছিল না। বিশ্বের অনেক দাবাড়ু চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কোচ ছাড়াই। খেলাটাই আসল, কোচিং নিলে সেটা আরো পরিশীলিত হয়।’

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জিএমের সংখ্যার পার্থক্য এতো বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে দুই জিএমের পর্যবেক্ষণ, ‘পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পনা ছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন অনেক দেশের ভিসা নিতে আমাদের কষ্ট করতে হয়। বাংলাদেশে দূতাবাসও নেই। ভারতে গিয়ে থেকে ভিসা নেয়ার ঝামেলায় অনেক টুর্নামেন্ট খেলা হয় না। সেখানে ভারতে দূতাবাস তো আছেই, সার্বিয়া সহ অনেক দেশে ভারতীয় দাবাড়ুরা অন অ্যারাইভাল, মাল্টিপল ভিসাও পায়।’

এজেড/এটি/এনইউ