আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর বার্ধক্যের সঙ্গে নানা শারীরিক জটিলতা ভর করেছে। নানা কাজ, ব্যস্ততা থাকলেও সপ্তাহের কিছুটা সময় আবাহনীর বারান্দায় কাটাতেই হবে তাঁর। 

ক্লাব ভবনের নিচতলার কোনার এই আড্ডা প্রায় পাঁচ দশকের। সেই আড্ডায় ছেদ পড়ছে গত দুই সপ্তাহ থেকে। আবাহনী ক্লাবের ভবন ভেঙে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স হচ্ছে। এতদিন অন্য অংশের কাজ হলেও ১৫ মে থেকে বারান্দার অংশ ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। তাই সেদিন সেখানে আড্ডা দেয়া অনেকেই হাজির হয়েছিলেন শেষবারের মতো প্রিয় জায়গায় নিজের শেষ পদচিহ্ন রাখতে। 

করোনা থেকে সেরে ওঠার পর পুরোনো স্মৃতি মনে রাখতে কষ্ট হলেও আবাহনীর বারান্দার ৫০ বছরের স্মৃতি হারুনের কাছে যেন তরতাজা- ‘ক্লাব গঠনের পর থেকেই আড্ডার শুরু। ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ৭৫-এর পর। বারান্দার আড্ডাটা তখন থেকেই।’ ক্লাবের বর্ষীয়ান কর্মকর্তা ও হারুনের বন্ধু মন্টু চেয়েছিলেন বারান্দার জায়গাটি সংরক্ষণ করতে- ‘ক্লাবের অনেক স্মৃতির অংশ এই বারান্দা। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছিল এই জায়গাটি রেখে সংস্কার করার। কিন্তু নকশা বাস্তবায়নে এটি করা যাবে না।’

ফুটবলে সোনালি দিনের গল্পের মধ্যে অন্যতম দলবদলের ঘটনাগুলো। এই বারান্দায় বসেই মোহামেডান ও অন্য দল থেকে খেলোয়াড় আনার পরিকল্পনা হতো, ‘সভা রুম থাকলেও এই বারান্দাতেই ক্লাবের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশি-নব্বই দশকের সময় ফুটবল, ক্রিকেট দলবদলের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখানেই হতো’ -স্মৃতি হাতড়ে বললেন হারুন। 

সময়ের পরিক্রমায় গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির দল গঠনের নানা সিদ্ধান্ত হয় ক্লাবের পরিচালকদের ব্যবসায়িক অফিসে। বারান্দার আড্ডা গত এক যুগে তাই শুধু আড্ডাতেই পরিণত হয়েছিল। 

আবাহনীর সাবেক ক্রিকেটার জালাল ইউনুস এখন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। ক্রিকেটের ব্যস্ততা ও বাসা ধানমন্ডি থেকে গুলশানে নিয়ে যাওয়ায় ক্লাবে যাতায়াত আগের মতো নেই। শারীরিক দুরত্ব কমলেও মনে তার সার্বক্ষণিক আবাহনীই আছে- ‘আবাহনী আমাদের প্রাণ। কত যে স্মৃতি এই বারান্দায়। জীবনের সোনালি ও বর্ণিল সময় যদি থাকে, তাহলে অবশ্যই আবাহনীর বারান্দায় কাটানো আড্ডার সময়গুলোর কথা বলতে হবে।’ আড্ডা মানে খাওয়া-দাওয়া। ক্লাবের সামনে থাকা চটপটি, ঝালমুড়িওয়ালারাও পরোক্ষভাবে আড্ডার অনুষঙ্গ ছিল। স্মরণ করলেন, ‘মোস্তাকিমের চাপ, নুরুর ফুচকা আমাদের নিয়মিত অংশ ছিল। এখনো সেই স্বাদ যেন অমৃত।’ 

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ লিপুরও অনেক স্মৃতি এই জায়গাটার ওপর, ‘আবাহনী ক্লাবের মাঠেই লিগের খেলা হতো। যখন খেলতাম তখন খেলা শেষে এখানে ম্যাচের আলোচনা করতে করতে কখন জার্সি শুকিয়ে যেত, টেরই পেতাম না। যখন কর্মকর্তা হলাম তখনকার আড্ডাটা আবার ভিন্ন স্বাদের।’ 

চার দশকের বেশি সময় আবাহনীর সঙ্গে জড়িত আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। আবাহনীর বারান্দায় সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো মানুষদের মধ্যে অন্যতম ববি। ক্লাবের এই অংশটুকু তাঁর জীবনেরই অংশ যেন- ‘কত যে দিন-রাত এখানে কেটেছে এর কোনো হিসাব নেই। যদি জীবনের অঙ্ক করা হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে কয়েক ভাগের মধ্যে এক ভাগ এখানেই কেটেছে।’

এই আড্ডার অনেক নিয়মিত মুখ পরপারে চলে গেছেন। সাবেক ফুটবলার অমলেশ সেন, হকি খেলোয়াড় জুম্মন লুসাইরা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কেউ দুনিয়া ছেড়েছেন, কেউ বিদেশে, আবার কেউ অসুস্থ। চরিত্রের বদল হলেও আড্ডাস্থলটি কখনো শূন্য থাকেনি। 

শুরুর দিকে এখানে ক্লাবের সিনিয়র কর্মকর্তারাই আড্ডা দিতেন। ধীরে ধীরে ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমর্থকরাও আড্ডায় যুক্ত হন ৷ সমর্থকরা যেমন ক্লাবের প্রাণ, তেমনি এই বারান্দাও ছিল আবাহনীর প্রাণ। আবাহনীর সমর্থক গোষ্ঠীর কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বাদশাও ছিলেন এই আড্ডার অংশ। কয়েক দিন আগে সবাইকে নিয়ে শেষ বারের মতো প্রিয় এই স্থানটি ফ্রেমবন্দী করার অন্যতম উদ্যোক্তাও তিনি। বলেন, ‘এই জায়গাটি ক্লাবের সবার পছন্দের। কখনো এই জায়গাটি ফাঁকা থাকে না। সকাল-বিকাল খেলোয়াড়রা এখানে বিশ্রাম নেয়। মূল আড্ডাটা হতো সন্ধ্যার পর।’

বারান্দাটি ক্লাব ভবনের এক প্রান্তের কোনায়। তাই অনেকে এটিকে বলতেন, ‘আবাহনীর কোনাবাড়ি।’ আধুনিক কমপ্লেক্স গড়ে উঠছে, তাই কোনাবাড়ি আর থাকছে না৷ এই জায়গাটির আবেদন এতটাই যে, শুধু আবাহনী নয়, ক্রীড়াঙ্গনের অনেকের মনের কোনায় এটি থাকবে দীর্ঘদিন।

এজেড/এটি/জেএস