দেশের প্রায় প্রতিটি খেলায় বিদেশি কোচ আসে-যায়, তাদের স্থায়িত্ব খুব বেশিদিন হয় না। এক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম তায়কোয়ান্দোর দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ লি জু সাং। তিনি ২২ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কোচিং করাচ্ছেন। দেশের অন্য কোনো খেলায় এতদিন টানা বিদেশি কোচের কোচিং করানোর রেকর্ড নেই। 

২০০০ সালে কোরিয়ান সরকারের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন লি। মূলত ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনে সহায়তা করতেই এসেছিলেন এই কোরিয়ান। ২০০২ সালে দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল তাকে বাংলাদেশে রাখার উদ্যোগ নেন। প্রয়াত মন্ত্রীকে এই কোরিয়ান কোচ স্মরণ করলেন এভাবে, ‘আমার এখনো মনে আছে, পটল সাহেব তখন মন্ত্রী। তিনি তায়কোয়ান্দোর বাংলাদেশে মান উন্নয়নে আমাকে রাখার জন্য ফেডারেশনকে কোরিয়ার দূতাবাস ও কোরিয়ান ফেডারেশনে চিঠি দিতে বলে। তার এই উদ্যোগের জন্যই বাংলাদেশের সঙ্গে আমার স্থায়ী পথচলা শুরু হয়।’

এসেছিলেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পরবর্তীতে তার দায়িত্ব ও পদবী পরিবর্তন হয়, ‘স্বেচ্ছাসেবক পদে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পদের উন্নতি ও স্থায়িত্ব দাবি ছিল আমার। সেই চাহিদা আমার দেশের সরকার পূরণ করেছে। আমার সম্মানী ও পদ দুটোই বাড়িয়ে বাংলাদেশে থাকার ব্যবস্থা করেছে।’ তার সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে বলেন, ‘আমার অর্থ কোরিয়ান ক্রীড়া সংস্থা দেয়। বাংলাদেশে আমার অথরিটি কোরিয়ান দূতাবাস আর কাজের ক্ষেত্র তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন।’ বাংলাদেশে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন লি। আবাসন ও সন্তানদের শিক্ষা খরচ তার বেতন থেকেই সংস্থান করতে হয়।

দুই দশকের বেশি সময় কোরিয়া বাংলাদেশকে তায়কোয়ান্দোতে সাহায্য করে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত লি জাং কিউন বলেন, ‘তায়কোয়ান্দো কোরিয়ানদের খুবই প্রিয় একটি খেলা। এই খেলার প্রচার-প্রসার এবং মান উন্নয়নের জন্য আমরা সহায়তা করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশে কোচ দিয়ে ও টুর্নামেন্ট আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকি।’

তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন প্রায় প্রতি বছরই কোরিয়ান অ্যাম্বাসেডর কাপ নামে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। এর সিংহভাগ খরচ দূতাবাসই বহন করে। তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের সভাপতি মোর্শেদ কামাল কোরিয়ান দূতাবাস ও তায়কোয়ান্দো ফেডারশেনের এই সম্পর্ক উদযাপন করতে চান, ‘আগামী বছর বাংলাদেশ ও কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হবে। সেই সময় আমরা ফেডারেশন ও দূতাবাসের প্রায় দুই যুগের সম্পর্কের একটা উদযাপন করব।’

কোরিয়ান এই কোচ বাংলাদেশে এতদিন থাকায় এখন পুরোপুরি বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। বাংলাতেই অবলীলায় কথা বলেন। খাবার দাবারেও বাংলাদেশি নির্ভরতা, ‘কোরিয়ায় যখন ছুটি কাটাতে যাই তখন মাঝে মধ্যে বাংলাদেশি ভর্তা, ডাল খেতে খুব ইচ্ছে করে। তিন চার দিন কোরিয়ান খাবার খাওয়ার পর বাংলা খাবার খেতে মন ছুটে যায়।’ লির স্ত্রী কোরিয়ান তবে তার দুই সন্তান বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়াশোনা করে এবং তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে দারুণ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

বামে কোচ আর তার পাশে কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত

দুই দশকের বেশি সময় তায়কোয়ান্দোতে লি। আগের ও বর্তমান তায়কোয়ান্দোর অবস্থা ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘মানগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম তখন এই দেশে তায়কোয়ান্দো সম্পর্কে মানুষ জানতই না। এখন ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে খেলা হয়। আন্তর্জাতিক পদকও আসছে। ২০০৬, ১০ ও ১৯ এসএ গেমসে বাংলাদেশ স্বর্ণ জিতেছিল।’ 

বাংলাদেশের তায়কোয়ান্দোর এই পরিবর্তন ও উন্নয়নের পেছনে কোচের অবদান স্বীকার করলেন দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক থাকা মাহমুদুল ইসলাম রানা, ‘তিনি বাংলাদেশের তায়কোয়ান্দোর শুরু থেকেই রয়েছেন। সব কিছুতেই তিনি অনেক দক্ষ। তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলোয়াড় তুলে আনতে পারেন। সিনিয়র খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুত করেন। বাংলাদেশের কোচ জাজরাও তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে।’

ফুটবল, ক্রিকেট এবং অন্য খেলায় ফেডারেশনের অর্থ দিয়ে কোচ রাখতে হয়। এখানে কোরিয়া থেকে অর্থায়ন হওয়ায় ফেডারেশনের অর্থ সংস্থান নিয়ে ভাবতে হয় না। এরপরও কোচের মান এবং তার আন্তরিকতার প্রশংসা করলেন রানা, ‘অন্য খেলার সাথে এই খেলার কোচের একটু পার্থক্য রয়েছে। এরপরও তাকে পারফরম্যান্স করেই থাকতে হয়। দুই বছর পরপর তার পর্যালোচনা হয়। রিপোর্টের ভিত্তিতে তার দায়িত্ব নবায়ন করে কোরিয়ান সরকার।’

২২ বছর বাংলাদেশে রয়েছেন। আর খুব বেশি থাকতে পারবেন না ভেবে কিছুটা মন খারাপ এই কোচের, ‘আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে ৬০ বছর বয়সে অবসর। ২০২৫ সালে আমার ৬০ বছর পূর্ণ হবে। তিন-চার বছর পর আমার ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না।’ 

এজেড/এটি/এইচএমএ