শারমিন আক্তার সুপ্তা, শিরিন আক্তার, কামরুন নাহার ডানা ও মাবিয়া আক্তার সীমান্ত (উপরে বাম থেকে)

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছেন নারী ক্রীড়াবিদরা। সেই পাকিস্তান আমল থেকে সুফিয়া খাতুন, রওশন আক্তার ছবিরা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে আসছেন। স্বাধীনতার পরে সুলতানা কামাল, শামীমা সাত্তার মিমো, কামরুন নাহার ডানা, জোবেরা রহমান লিনু, সাবরিনা সুলতানা, হালের মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, মাহফুজা খাতুন শিলা, ডালিয়া আক্তার, সাবিনা খাতুন, শারমিন আক্তার সুপ্তারা সেই আলোর শিখা বয়ে চলছেন।

তাদের এই আলোর নিচে রয়েছে অনেক অন্ধকারের গল্প। সেই গল্পগুলো অনেক যন্ত্রণার, বঞ্চনার এবং নির্যাতন-নিপীড়নেরও। অনেক নারী ক্রীড়াবিদ নিরবে-নিভৃতে কেদে ক্রীড়াঙ্গন থেকে দূরে সরে গেছেন। নিপীড়নের শিকার না হলে হয়তো তারাও একদিন লিনুর মতো গিনেজ বুকে, শিলা-সীমান্তের মতো তাদের নামও লিখাতে পারতেন। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বর্তমান ও সাবেক নারী ক্রীড়াবিদ, সংগঠকদের একটাই চাওয়া ‘ক্রীড়াঙ্গন হোক নিপীড়ন মুক্ত’।

টানা দুই গেমসে ভারত্তোলনে স্বর্ণ জিতেছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। বর্তমানে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অগ্রগণ্য এক সৈনিক। ক্রীড়াঙ্গনে নারী নিপীড়নমুক্ত করতে এই ক্রীড়াবিদের পরামর্শ, ‘রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অথবা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি বিশেষ আইন থাকা উচিত নিপীড়ন বন্ধের জন্য।’ 

মন্ত্রণালয় বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আইন হলে নিজেদের আরো একটু নিরাপদ বোধ করতে পারবেন বলে মনে করেন এই ভারত্তোলক, ‘সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা সব সময় একটু অস্বস্তিতে থাকে। ক্রীড়াঙ্গনেও কম বেশি থাকতে হয়। যখন এ রকম একটি আইন থাকবে তখন হয়তো আমাদের স্বস্তির জায়গাটা বাড়বে।’ 

দুই যুগের বেশি সময় হ্যান্ডবল খেলছেন ডালিয়া আক্তার। ক্রীড়াঙ্গনকে নিপীড়নমুক্ত দেখতে চান এই ক্রীড়াবিদও। তার দৃষ্টিতে নিপীড়ন বন্ধে প্রয়োজন, ‘পরিবার থেকেই ছেলে ও মেয়ে উভয়কে ছোটবেলা থেকে বাজে স্পর্শ সম্পর্কে ধারণা দেয়া দরকার। ছোট বয়সে এই ধারণাগুলো পেলে পরবর্তীতে ক্রীড়াঙ্গন বা পেশাগত জীবনে একজন নারী নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবে।’ 

খেলার পাশাপাশি কোচিংও করাচ্ছেন ডালিয়া। নিপীড়ন বন্ধে নারী কোচের সংখ্যা আরো বাড়ানো দরকার বলে মত দিয়েছেন তিনি, ‘নারীরা যখন নারীদের অধীনে কোচিং করাবে তখন নিপীড়নের অভিযোগগুলো অনেক কমে যাবে। এজন্য ফেডারেশনগুলোর উচিত নারী কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিকেএসপি’র উচিত নারী কোচদের সুযোগ দেয়া।’ 

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নিপীড়নের অভিযোগ বেশি ওঠে সাতার, অ্যাথলেটিক্সকে ঘিরে। সাতারের মতো ডিসিপ্লিনে নিপীড়নের অভিযোগ বেশি ওঠার পেছনে এক সময়ের সেরা সাতারু, বর্তমানে কোচ ও সংগঠক নিবেদিতা দাস মনে করেন, ‘সাতার অনেক কষ্টের খেলা। অনেক ছোট বয়স থেকেই এই খেলা শুরু করতে হয়। ফলে জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে অনেক নারী এ রকম অনাকাঙ্খিত নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। শিক্ষার অভাব ও অসচেতনায় তারা হয়তো বুঝেও না এটা যে নিপীড়ন। পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতায় সেটা আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।’ 

নিপীড়ন রোধে নারী কোচের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে হ্যান্ডবলের ডালিয়ার সাথে একমত নিবেদিতা, ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে অবশ্যই কোচের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে এক পর্যায়ে বা সময়ে এটি শূন্যের কোঠায় এসে পড়বে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের এই উপ-পরিচালক আরো বলেন, ‘নারীদেরকে মান সম্মত কোচ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কোচ মেধাবী ও প্রশিক্ষিত না হলে তখন আবার মেধাহীন ক্রীড়াবিদ তৈরি হবে।’

মেধাবী ও প্রশিক্ষিত নারী কোচ তৈরির ক্ষেত্রে নিবেদিতা আবার ভিন্ন ধরনের নিপীড়নের সন্ধান পেয়েছেন, ‘নিপীড়ন বলতে আমরা শুধু শারীরিক নিপীড়ন বুঝি, মানসিক, পেশাগতও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয় নারীদের। সেগুলো দূর করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া এগুলো দূর করা সম্ভব নয়।’ 
দেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। তিনি শিক্ষার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন, ‘যতদিন পর্যন্ত না আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হবে ততদিন আমাদের এই সমস্যাগুলো থেকেই যাবে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি।’

জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের ওপেনার শারমিন আক্তার সুপ্তা নারী নিপীড়ন রোধে ভিন্ন দু’টি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে কোনো ঘটনা বা অভিযোগ উঠলে গণমাধ্যমে আসে। জেলা, বিভাগ পর্যায়ে এ রকম ঘটনার সংখ্যা বেশি। অনেক নারীর ক্রীড়ার স্বপ্নটা নিজ জেলা, অঞ্চলেই শেষ হয়ে যায়। এখানে জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর বেশি কাজ করা দরকার। ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে অন্য ডিসিপ্লিনগুলোতেও নারীদের জন্য বিশেষ উইং থাকা উচিত। যারা নারীদের বিষয়গুলো দেখবে।’ 

অনেক ফেডারেশন অবশ্য এখন জাতীয়/আন্তর্জাতিক নারী প্রতিযোগিতাগুলোতে নারী ম্যানেজার ও কর্মকর্তা নিয়োজিত করছে। এই বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন সুপ্তা, ‘নারীদের অনেক বিষয় পুরুষ ম্যানেজার ও কর্মকর্তার সাথে বলা যায় না। সেক্ষেত্রে নারীদের একজন মহিলা ম্যানেজার বা কর্মকর্তা থাকলে বিষয়টি অনেক নারীবান্ধব হয়।’

নারী ক্রীড়াবিদদের নিরাপত্তা, সচেনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার দায়িত্ব মহিলা ক্রীড়া সংস্থার। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা সেই দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতে পারছে না বলে দায় স্বীকার করে নিলেন সাধারণ সম্পাদক নেইলি, ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সমস্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা দরকার। কিন্তু আমাদের সেই সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। বাজেট স্বল্পতা, আইনী দুর্বলতা, লোকবল সংকট সহ নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ 

সীমাবদ্ধতা উত্তরণের চেষ্টা রয়েছে বর্তমান কমিটির। নেইলির ভাষ্য, ‘আমাদের সভানেত্রী একটি মহিলা ক্রীড়া ফাউন্ডেশন করার চেষ্টা করছেন। সেটা হলে আমরা সেখান থেকে নারী ক্রীড়াবিদদের এই যাবতীয় সমস্যাগুলো আরো সুচারুরূপে দেখতে পারব।’

দেশের ক্রীড়া যে কোনো আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক কামরুন নাহার ডানা। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরো কিছু সমস্যা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অনেক দিন যাবত অ্যাডহক কমিটি। অ্যাডহক কমিটি থাকলে কখনোই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হতে পারে না কোনো সংগঠনে। জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে নারী প্রতিনিধিত্ব কোটা আকারে নিশ্চিত করতে হবে। নিপীড়ন বন্ধে এর কোনো বিকল্প নেই।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মডেল গঠনতন্ত্রে প্রতি ফেডারেশনের নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। সেই গঠনতন্ত্র জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এজিএম না হওয়ায় পাশ হয়নি গত কয়েক বছরে। ফলে আইনটি অনুমোদন না হওয়ায় নারী ক্রীড়াবিদদের নিরাপত্তা সংকুচিত হচ্ছে।

নিপীড়ন রোধে নারী ক্রীড়াবিদদের পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশ: 

  • প্রতি ডিসিপ্লিনে নারী কোচের সংখ্যা বাড়ানো।
  • রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অথবা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিপীড়ন সংক্রান্ত বিশেষ আইন করা।
  • জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে কোটার মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
  • নারী দলে নারী ম্যানেজার/কর্মকর্তা নিশ্চিত করা।
  • মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে আরো বেশি যুগযোপযোগী ও গতিশীল করা।
  • খেলোয়াড়,ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।