দুই পুলিশের দাবা প্রেম
বামে আতিকুর রহমান, ডানে কামরুজ্জামান
আতিকুর রহমান খুলনা রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি, কামরুজ্জামান চাঁদপুর নৌ পুলিশের এসপি। পেশাগত ব্যস্ততা ও নানা চাপের মধ্যেও পুলিশের এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মনেপ্রাণে দাবা।
প্রাত্যহিক নানা কাজের মধ্যে একটু সময় পেলেই দাবায় মেতে উঠেন কামরুজ্জামান, ‘কোনো মিটিংয়ে এসেছি। মিটিং বিলম্বে শুরু বা দ্রুত শেষ সেই সময়টা অনলাইনে দাবা খেলি। গাড়িতে কোথাও যাচ্ছি, সেখানেও সঙ্গী দাবা।’ আতিকুর রহমানেরও দাবার প্রতি এ রকমই নেশা, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনে নানা কাজে নানা জায়গায় যেতে হয়। এমনও হয়েছে রাস্তার ধারে কাউকে দাবা খেলতে দেখলে দাঁড়িয়ে যাই। একটু সময় পেলে তো নিজেই খেলতে বসি।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলা থেকেই দাবার প্রতি তার প্রেম, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনে অনেক বিকেল কেটেছে দাবা খেলে। সাব জুনিয়র, জুনিয়র, ন্যাশনাল বি, মহানগরী অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছি। এখনও খেলে চলছি,’ পুরনো স্মৃতি স্মরণ করলেন আতিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পড়াশোনার পর পূবালী ব্যাংকে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন আতিক। পূবালী ব্যাংক দাবা দল গঠনে তার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ব্যাংক দলের মতো পুলিশ দল গঠনেও রয়েছে তার উদ্যোগ, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই পছন্দের। আমার মতো পুলিশে কর্মরত আরো অনেকের দাবার প্রতি আগ্রহ রয়েছে। এদের নিয়ে পুলিশ দাবা দল গঠনের তাগিদ অনুভব করি। সিনিয়র স্যারদের সহায়তায় পুলিশ এখন দাবায় যথেষ্ট ভালো দল।’
বিজ্ঞাপন
প্রিমিয়ার দাবা লিগে পুলিশ শিরোপার জন্য লড়ে। দ্বিতীয় বিভাগ দাবায় পুলিশেরই রয়েছে পাঁচটি দল। এই পাঁচ দলে পুলিশে কর্মরতরাই খেলছেন। কেউ অতিরিক্ত ডিআইজি, কেউ এসপি, আবার কেউ রয়েছেন এসআই, কন্সটেবল। দাবার চাল নিয়ে এসআই, কন্সটেবলদের পরামর্শ অনেক সময় নিচ্ছেন উর্ধ্বতনরা। খেলার সময় পেশাগত পদমর্যাদা ভুলে যান সবাই, ‘আমরা এখানে সবাই দাবাড় পরিচয়ে এসেছি। কে কোন পদে , সেটা বিষয় নয়। আমাদের এখানে পেশাগত কোনো আলোচনা নেই, শুধু দাবার কথা। আবার অফিসে যখন যাব, তখন আবার শুধু কাজের বিষয়,’ বলছিলেন ২২ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করা আতিক। যিনি পুলিশে কর্মরত অফিসারদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত সক্রিয় দাবাড়।
রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করে বাংলাদেশ পুলিশ। এত কাজের মধ্যেও দাবার জন্য সময় বের করে নেয়ার গল্পটা বললেন কামরুজ্জামান, ‘৩ মাস পরপর ব্যক্তিগত কিছু ছুটি নেওয়া যায়। সেই ব্যক্তিগুলো ছুটি না নিয়ে একবারে খেলার সময় ছুটি নিয়ে থাকি।’ অনেক সময় ছুটি না নিয়েও খেলতে হয়েছে তাকে, ‘ঢাকায় যখন পোস্টিং ছিল তখন কিছু রেটিং টুর্নামেন্ট খেলেছি। পেশাগত কাজ কিছুটা গুছিয়ে খেলতে আসতে বিলম্ব হয়ে যেত। আবার অনেক সময় প্রতিপক্ষ ওয়াকওভারও পেয়েছে।’
এত চাপ ও ব্যস্ততার মধ্যেও দাবাকে ছাড়ার বিষয় ভাবতে পারেন না কামরুজ্জামান, ‘দাবা আমার ভালোবাসা ও নেশা দুটোই। বড় দাবাড় হতে পারেনি কিন্তু ভালোবাসার টানে দাবা খেলে যাচ্ছি, বাকি জীবনেও খেলব।’ বুয়েট অ্যালামনাই এসোসিয়েশন আয়োজিত দাবা, অফিসার্স ক্লাব, আন্তঃপুলিশ দাবায় শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে কামরুজ্জামানের।
দাবার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে অনেক সফলতা পেয়েছেন, ‘দাবায় খুব তীক্ষ্ণভাবে মনোযোগ ও ধৈর্য রাখতে হয়। দাবার মাধ্যমে একটি বিষয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটিভাবে ভাবতে হয়। যা পেশাগত অনেক সংকটপূর্ণ সময়ে আমাকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে।’
আতিক ও কামরুজ্জামান দুই জনেরই রেটিং ১৮০০ অধিক। খুব বেশি নিয়মিত জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ না হওয়ায় তাদের রেটিং ২০০০ অধিক হওয়ার সম্ভাবনা সেই অর্থে নেই। দাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা কিন্তু কোনো টাইটেল যুক্ত না হওয়ায় খানিকটা আফসোস রয়েছে দুই জনেরই। তবে এখন নিজেদের আফসোস ছাপিয়ে জাতীয় সংকটই তাদের মন কাঁদে, ‘আমরা যখন দাবা শুরু করি তখন দাবার দারুণ পরিবেশ ছিল। খেলাটির অনেক সম্ভাবনাও ছিল।’
নিজেদের পেশাগত অবস্থান থেকে দাবার জন্য কাজ করার চেষ্টা করেন দু’জনই। জেলা পর্যায়ে দাবা টুর্নামেন্ট আয়োজন, দাবায় উৎসাহীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
দাবাপ্রিয় কামরুজ্জামান পুলিশের পেশা দারুণ উপভোগ করছেন, ‘বুয়েটের ছাত্র হিসেবে উচ্চতর শিক্ষায় আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা ছিল। টুইন টাওয়ার হামলার পর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আমেরিকা গমন সংকটের মধ্যে পড়ে। তখন বিসিএসের দিকে ঝুঁকি। ২৪ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেই। একজন প্রকৌশলী হয়েও পুলিশ ক্যাডারে দারুণ উপভোগ করছি।’ জিয়া-রিফাতদের সঙ্গে খেলা আতিকও সন্তুষ্ট, ‘আসলে বাংলাদেশে দাবা পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ সেভাবে ছিল না। দাবায় বেশি মনোযোগী হলে হয়তো পেশায় এই পর্যায়ে পৌছানো হতো না।’
এজেড/এনইআর/এটি