হ্যান্ডবল তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনে নারী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অন্যতম বাকপটু ডালিয়া আক্তার। সেই ক্রীড়াবিদের কন্ঠ কিছু সময়ের জন্য রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাইক নিয়ে নিশ্চুপ দাড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখ মুছলেন কয়েকবার, গলায় আড়ষ্টতা। শহীদ ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী স্টেডিয়ামের কোর্টে বল নিয়ে গোল পোস্টের দিকে ছুঁটেছেন অনবরত। বল নিয়ে সেই ছোটা যে আর হবে না তার। সেটি ভাবতেই কেমন যেন লাগছে ডালিয়ার, ‘এ দিনটি আমার জন্য বিশেষ। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছি না। হ্যান্ডবলের ডালিয়া, হ্যান্ডবলেই থাকবে।’ 

দেশের হ্যান্ডবলের অন্যতম তারকা তাই ফেডারেশন বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবেই বিদায় জানানোর ব্যবস্থা করেছিল ডালিয়াকে। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনূরসহ প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ ও মাদারীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার খেলোয়াড়েরা দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে ছিলেন। সাবেক খেলোয়াড়, কোচ সহ আরো অনেকে এসেছিলেন ডালিয়াকে বিদায় বেলায় ফুল দিতে।

ত্রিশ বছর হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনূর। ডালিয়ার বিদায় বেলায় ডালিয়ার জনপ্রিয়তার কথা বললেন এই সংগঠক, ‘হ্যান্ডবলে অনেক খেলোয়াড়ের নাম আমি বলতে পারি না, মনেও থাকে না। ডালিয়ার নাম শুরু থেকেই মনে ছিল। সংগঠক হিসেবে অনেক জায়গায় সভা-সেমিনারে যেতে হয়, সেখানে হ্যান্ডবলের কথা উঠলে দেখেছি মানুষজনকে ডালিয়ার কথা বলতে। ডালিয়া অবসর নিলেও আমাদের সাথেই থাকবে।’

১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে মাদারীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে অভিষেক ডালিয়ার। ২০২১ সালে নিজ জেলা মাদারীপুরের হয়েই জার্সি-বুট তুলে রাখলেন বাংলাদেশের এই কৃতি হ্যান্ডবল খেলোয়াড়, ‘আমি দীর্ঘদিন বিজেএমসির হয়ে খেলেছি। করোনার সময়ে বিজেএমসি’র ক্রীড়া বিভাগ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় নিজ জেলার হয়েই শেষ করলাম খেলা।’ জীবনে অনেক ম্যাচ জিতলেও অবসরের দিন বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে হেরেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে ডালিয়ার মাদারীপুরকে। 

২০১৮ সালে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন এর তিন বছর পর নিলেন ঘরোয়া পর্যায় থেকেও। খেলোয়াড় থাকাবস্থাতেই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করিয়েছেন। কোচিংয়েই পুরোপুরি মনোযোগ ডালিয়ার, ‘খেলোয়াড় হিসেবে ভারতকে হারাতে পারিনি। কোচ হিসেবে আমার লক্ষ্য থাকবে ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয়। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা দল। ভারতকে হারাতে পারলেই আমরা তৃপ্ত হব’। ডালিয়া পুরুষ দলকে বেশি কোচিং করিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে। সামনে নারী-পুরুষ যে কোনো দলকেই কোচিং করানোর ইচ্ছে এই কৃতি হ্যান্ডবল খেলোয়াড়ের,‘ আমি নারী দলগুলোতে খেলেছি ফলে সেই দলগুলোতে সেভাবে কোচিং করানোর সুযোগ ছিল না। তাই পুরুষ দলে বেশি কোচিং করিয়েছি। বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন আমাকে যে দলে কোচিং করানোর সুযোগ দেবে আমি সেখানেই করব।’ 

ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়রা ক্যারিয়ার শেষ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিকেএসপি, জেলা ক্রীড়া পরিদপ্তরের দিকেই বেশি ঝুকে কোচিংয়ের জন্য। ডালিয়া এক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রমী ভাবছেন, ‘আমার বয়স এখন ৩৫। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে স্থায়ী কোচ হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা কম। মাস্টার রোলে সুযোগ থাকলে কাজ করতে চাই। না হলে হ্যান্ডবল ফেডারেশন বা বিভিন্ন সংস্থায় কোচিং করাব।’ কোচিং ছাড়াও ডালিয়া একটি বেসরকারি স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

ডালিয়া হ্যান্ডবল ছাড়াও ফুটবলও খেলেছেন অনেক দিন। জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। মোহামেডান, বিজেএমসির হয়ে ফুটবল লিগও খেলেছেন। অবসরের পর এখন শুধু হ্যান্ডবলের ডালিয়া হয়েই থাকার ইচ্ছে তার, ‘ফুটবলে আমি কিছুটা বঞ্চিত হয়েছি। এজন্য ফুটবলে সেভাবে সম্পৃক্ত হইনি। আমি হ্যান্ডবলে যে পর্যায়ে পৌছেছি, হ্যান্ডবলেই থাকতে হবে আমাকে। এছাড়া সামগ্রিকভাবে নারী ক্রীড়া উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’
 
ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায় মিলিয়ে হাজার গোল ডালিয়ার। দেশের নারী হ্যান্ডবলে ডালিয়াকে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়ের তকমা অনেকে দিলেও নিজেকে সেভাবে ভাবেন না, ‘আমি সব সময় গোল করে দলকে জেতাতে চেয়েছি। আমি ১৮ বছর জাতীয় দলে খেলেছি। এজন্য হয়তো অনেকে আমাকে এমন স্বীকৃতি দেয়। আমি নিজেকে কখনো সেভাবে ভাবিনি’। নিজের গোল সংখ্যা নিয়ে মজা করে বলেন,‘ অসংখ্য গোল করেছি। হাজার তো হবেই। হ্যান্ডবলে গোল হয় অনেক। এমন হয়েছে আমাদের দল গোল দিয়েছে ৪২টি। এর মধ্যে আমি ১৮টি। প্রতিপক্ষ ২৪টি। আমার দলের অনেকে বলত, ‘আমরা সবাই ড্র করেছি, তুই জিতেছিস।’ 

দুই দশকের ক্যারিয়ারে ডালিয়া প্রাপ্তি হিসেবে দেখেন ২০১৬ এসএ গেমসে নারী দলের রৌপ্য জয়কে। অপ্রাপ্তি ভারতকে না হারাতে পারা,সেটা কোচিংয়ের মাধ্যমে কবে নাগাদ পারবেন সেটাই দেখার অপেক্ষায় হ্যান্ডবল অঙ্গন। ৩৫ পেরিয়ে যাওয়া ডালিয়া এখনো হ্যান্ডবল নিয়েই থাকতে চান। ব্যক্তিগত জীবন সংসার নিয়ে আরো পরে ভাবার ইচ্ছে তার।

এজেড/এটি/টিআইএস