মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের রিংয়ে লড়ছেন চাপাইনবাবগঞ্জের কায়েমা খাতুন। জাজ ম্যাচ শেষ করতেই কায়েমার চোখে  জল। কয়েকবার হাত দিয়ে মুছেও জলের ধারা থামছিল না। ৪৮ কেজি ফ্লাইওভারে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে স্বর্ণ এনে দিয়েছেন কায়েমা। শিষ্যের কান্না থামাতে রিংয়ে উঠেন কোচ রাজু আহমেদ। পাঁচ বছর কায়েমাকে কোচিং করাচ্ছেন। অনেক সংগ্রামের গল্পের পর কায়েমার এই স্বর্ণে আনন্দাশ্রু কোচের চোখেও। 

মাত্র তিন মাস বয়সে কায়েমা বাবাকে হারান। জন্মের তিন মাস থেকেই তার সংগ্রামের শুরু, ‘আমার যখন মাত্র তিন মাস। তখন বাবা দাদির সাথে অভিমান করে বিষপান করে মারা যান।’ -বলছিলেন কায়েমা। যখন হাঁটতে শেখেন তখন জীবন-জীবিকার টানে কায়েমার মা সুমী বেগম দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। 

ছোট্ট কায়েমা নানী নূরজাহান বেগমের কাছেই রয়ে যান। সেখানেই বেড়ে উঠতে থাকেন। নানী নূরজাহান বেগম মেসে রান্না করে নিজে চলেন ও নাতনিকে চালান। নানীর এই কষ্ট থেকে মুক্তির জন্যই বক্সিং বেছে নেওয়া কায়েমার, ‘আমার নানী ও মা খুব কষ্ট করে। আমি খেলার মাধ্যমে নিজে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে চাই। সেই লক্ষ্যে নিজেকে বক্সিংয়ে সম্পৃক্ত করি।’ 

চাপাইনবাবগঞ্জ বক্সিং একাডেমিতে আসার পর বাকি অধ্যায়টুকু কোচ রাজু আহমেদের মাধ্যমেই পথ চলছেন এই বক্সার। রাজু কায়েমার সংগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী, ‘অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান সে। এমনও দিন যায়। তিন বেলা খেতে পারে না। দুয়েক বেলা রুটি খেয়ে পার করে। খেলার পাশাপাশি তার পড়ালেখায় আমরা সাহায্য সহযোগিতা করছি।’ 

বালিগঞ্জ গ্রামে আদর্শ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন কায়েমা। সেখানেও তার বিড়ম্বনা, ‘আমার প্রস্তুতি ভালোই ছিল। পরীক্ষার কিছুদিন আগে টাইফয়েড রোগ হয়। এজন্য প্রথম দিকে পরীক্ষাগুলো ভালো হয়নি। ৩.০৬ জিপিএ নিয়ে পাশ করি।’ 

এখন এইচএসসিতে পড়লেও জিপিএ’র উন্নতির চেয়ে তার লক্ষ্য পরিবারের সাহায্য করা, ‘আমি পরিবারকে কিছুটা সাহায্য করতে পারলে নিজের জীবন সার্থক মনে করব।’ তার স্বর্ণ প্রাপ্তির খবরে পরিবার খুশি। সৎ বাবা হলেও কায়েমা তেমন বঞ্চনার শিকার হন না বলে জানান, ‘আমার মায়ের পরবর্তীতে দুই ছেলে (পাঁচ ও দুই বছর) হয়েছে। আমার পরবর্তী বাবা সেই ভাইদের আমাকে উদাহরণ দেখিয়ে বলে দেখো কত ভালো খেলে আবার পড়ে।’ 

মা নতুন বিয়ে করলেও কায়েমার খোঁজ খবর রাখেন। এরপরও নানীর কাছেই স্বাচ্ছন্দ্য কায়েমার, ‘মায়ের নতুন বাসা নানীর কাছাকাছি। ছোট্টবেলা থেকে নানীর কাছে থাকায় এখনো নানীর কাছেই আছি।’  মা ও নানী দু’জনই মেসে রান্না করেন। গতবছর লকডাউনে রান্নার কাজ বন্ধ থাকায় অনেক কষ্ট হয়েছে তাদের। তখন কায়েমারও টুকটাক কাজ করতে হয়েছে জীবিকার জন্য।

সংগ্রামী এই নারী মেধাবী বক্সারকে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুহিন আঁচ করতে পেরেছিলেন গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। আজকে স্বর্ণ জয়ের পর কায়েমার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক, ‘বক্সিং ফেডারেশন কায়েমার পাশে থাকবে। কোনো সংস্থায় স্থায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত ফেডারেশন তাকে আর্থিক সাহায্য করবে। এ রকম মেধাবী বক্সারের পাশে থাকাই তো ফেডারেশনের কাজ।’ 

কায়েমার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ আনসার ইতোমধ্যে যোগাযোগ করছে। কোচ রাজু আহমেদ সুযোগ সুবিধা ও ভবিষ্যৎ বিচার বিবেচনা করে কায়েমাকে সংস্থা নির্বাচন করে দেবেন। তার অবশ্য এত বাছবিচার নেই নানী ও মাকে কিছু যোগান দিতে পারলেই চলে। 

এজেড/এটি/এমএইচ