বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিক্স টার্ফ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে কয়েক বছর আগেই। এরপরও এই টার্ফেই হয়েছে জাতীয় প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন। এই টার্ফের দুঃখ, দুদর্শার কথা কান পেতে শুনেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।

কয়েক ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠান। এটাই হয়তো আমার শেষ বড় কোনো অনুষ্ঠানের সাক্ষী হওয়া। শুনছি কয়েক মাসের মধ্যেই আমাকে উঠিয়ে এখানে নতুন টার্ফ বসানো হবে।  

আমার জন্মের সঠিক দিন তারিখ স্থান মনে নেই। মানসম্পন্ন টার্ফ হিসেবে আমার স্বীকৃতি ২০০৫-০৬ সালের দিকে যখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রতিস্থাপিত হয়েছিলাম। আমাকে ঘিরে অ্যাথলেট ও ক্রীড়াঙ্গনের লোকের অনেক আগ্রহ ছিল। কারণ আমার দামও ছিল অনেক (শুনেছি কয়েক কোটি টাকা)। 

তরুণ-তরুণীরা আমার ওপর দৌড়াত ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে। আমার তখন যৌবনকাল। যৌবনকালে মানুষ যেমন বেশি খাটতে পারে, আমারও তেমন অনেক পরিশ্রম সইতে হয়েছে। অনুশীলনের পর অনুশীলন, খেলার পর খেলা হয়েছে আমার ওপর। তাই যৌবন থাকতেই আমি বার্ধক্যের দিকে পা বাড়াই। 

বার্ধক্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু আগে আসলেও আমি খেলার উপযোগী ছিলাম। ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব-মানবী আমার ওপর দৌড়েই হয়েছে। সারা বিশ্বের জনগোষ্ঠীর দশভাগের একভাগ দক্ষিণ এশিয়ায়। সেই দশভাগের একভাগের সবচেয়ে দ্রুততম মানব-মানবীকে আমি ধারণ করেছি। আমার উপর দিয়ে হেঁটেই বিশ্বসেরা ফুটবলার মেসি ২০১১ সালে এই মাঠে ফুটবল খেলেছে। বিশ্বের অনেক নামী-দামী খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক আমার উপর দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি। এদের পদার্পণ আমাকে করেছে গর্বিত। 

আমি অ্যাথলেটিক্স টার্ফ হলেও অ্যাথলেটরা আমাকে সেভাবে খুব বেশি ব্যবহার করতে পারেনি। বছরে কয়েক দিন জাতীয়, গ্রীষ্ম আর জুনিয়র আয়োজন হয়। আমার কোল ঘেষেই ফুটবল মাঠ হওয়ায় ফুটবলাররাও আমার ওপর দৌড়ায়। আবার মাঝে মধ্যে সাইক্লিং প্রতিযোগিতাও হয়েছে। বড়, ভারী সাইকেলের ভার আমি সইতে পারতাম না। খুব কষ্ট ও ব্যথা পেতাম। 

তাও চোখ-কান বুঝে মেনে নিতাম। অন্য কেউ না বুঝলেও সাংবাদিকরা আমার কষ্ট বুঝতো। সাইক্লিং আমার বুকে কেন? এসব নিয়ে প্রশ্ন করতো প্রায়ই। এজন্য গত দু’তিন বছর আমাকে আর সাইক্লিংয়ের ভার সইতে হচ্ছে না। 

সাইক্লিংয়ের ভার না সইলেও বড় বড় গাড়ির ভার আমাকে নিতেই হয়। উদ্বোধনী-সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল গাড়ি আমার বুকের ওপর দিয়েই যায়। আমি ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, ধরে নিলাম সাইক্লিংয়ের হলেও ক্রিকেট ও বাংলাদেশের অনেক বড় অনুষ্ঠান আমার ওপর হয়েছে। 

২০১০ সালের এসএ গেমস, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসের উদ্বোধন-সমাপনী, ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমসের উদ্বোধনের স্বাক্ষী আমি। অনুষ্ঠান মাঠে হলেও মূল ঝক্কি তো আমার ওপর দিয়েই গিয়েছে। নানা যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম, অনবরত মানুষের চলাচল সবই আমার সইতে হয়েছে। আমার অনেক কষ্ট হলেও খুশি হয়েছি বাংলাদেশের সুনাম হয়েছে সারা বিশ্বে। 

২০১৪ সালের পর থেকেই আমাকে বার্ধক্য পেয়ে বসে একেবারে। ধীরে ধীরে আমি শুষ্ক, রুক্ষ হতে থাকি। ছেলেমেয়েরা আমার ওপর দৌড়ে শান্তি পায় না। আমিও নিজের আমার ওপর সন্তুষ্ট না। এভাবে তাও দুই-তিন বছর চলল। ২০১৭’র পর থেকে আমি একেবারে নিস্তেজ ও অকেজো। আমার দেহে ফাটল ধরা শুরু করল। 

ফাটলের মধ্যেই দৌড়ঝাপ, হাঁটা চলা হওয়ায় ফাটল বাড়তে থাকল। সেটা ঢাকার জন্য তারকাটা মারা শুরু করল আমার গায়ে। মৃত্যুর আগেই মৃত্যুযন্ত্রণা সেটা যদি তারা বুঝত। এর উপর শিরিন-ইসমাইলরা কয়েক বছর দৌড়াচ্ছে। আমার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে তো কষ্ট হয়ই, এর চেয়ে ওদের কষ্ট দেখে আমার আরো বেশি কষ্ট লাগে। টাইমিং উন্নতি তো দূরে, আমার বার্ধক্য বা অসামর্থ্যতার কারণে ওরা কেউ এখনো আহত হয়নি সেটাই এখন আমার সৌভাগ্য। 

আমার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের হলেও তাদের সাধ থাকলেও খুব বেশি সাধ্য নেই! বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের হওয়ায় তারাই আমার আসল মালিক। গত এক যুগে ক্রীড়া পরিষদের সচিব, চেয়ারম্যান বদল হয়েছে অনেক। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক পরিকল্পনা শুনেছি তেমন কিছু হয়নি। 

কিছুদিন যাবৎ শুনছি আমাকে উপড়ে ফেলা হবে। দরপত্রও কেনা-বেঁচা শেষ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নাকি আমার উত্তরসূরি স্থলাষিভিক্ত হবে। আমি তো কিছুদিন পর মরেই যাব। মরার আগে একটা কথা, আমার ওপর যা হয়েছে আমার উত্তরসূরির সাথে যেন সেটা নয়। এই কথাটা বলে একটু বিশ্রামে যাই। 

ধুর, কি বলি, আমার আবার বিশ্রাম হয় নাকি। কাকডাকা ভোরে রেফারি, ছোট বাচ্চা, বয়স্করা দৌড়ায়। দুপুর পার না হতেই ফুটবলারদের হাটাচলা শুরু, চলে রাত পর্যন্ত। ফ্লাডলাইটের আলো বন্ধ হলে আবার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য হাঁটে অনেক। 

মানুষরা যখন চলে যায়। মধ্যরাতে কুকুররা আমার উপর দৌড়ায়, চিৎকার করে। বিশ্রাম, ঘুম কিছুই হয় না। এভাবেই কেটে গেছে আমার দিন মাস, বছর। আর বাঁচবই বা কয় দিন! 

এজেড/এটি/এমএইচ